অবহেলা নিরূপণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় পুলিশ
শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় ভুল চিকিৎসা ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে দায়ের করা মামলার তদন্ত শুরু হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। রাজধানীর বাড্ডার সাঁতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খতনার জন্য অজ্ঞান করা হয় তাকে। এরপর আর জ্ঞান ফেরেনি।
শিশু আয়ানের মৃত্যুর পর গত মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) রাজধানীর বাড্ডা থানায় মামলাটি দায়ের করেন তার বাবা মো. শামীম আহমেদ।
পুলিশ বলছে, মামলায় ভুল চিকিৎসা ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পুলিশের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আদালতকেও জানানো হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিবেদন পাওয়ার পর আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
পুলিশ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, সুন্নাতে খতনা করাতে গত ৩১ ডিসেম্বর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু আয়ানকে ভর্তি করায় পরিবার। সেখানে তাকে অস্ত্রোপচার পূর্ববর্তী এনেসথেসিয়া দেওয়ার পর টানা তিনদিন জ্ঞান ফেরেনি। পরে তাকে গুলশান-২ এর ইউনাইটেড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৭ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১টার দিকে মারা যায় শিশুটি।
ঘটনার পর চিকিৎসকদের গাফিলতির অভিযোগ তদন্তে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধানের নেতৃত্বে ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য ৩ সদস্যের মধ্যে ১ জন মুগদা হাসপাতালের এনেসথেসিয়া বিভাগের বিশেষজ্ঞ, আরেকজন মুগদা হাসপাতালেরই একজন সহকারী পরিচালক। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালকও রয়েছেন এ কমিটিতে। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয় কমিটিকে।
অন্যদিকে শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করে সাত দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি দেশের সব অনুমোদিত ও অননুমোদিত হাসপাতাল-ক্লিনিকের তালিকা এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। সোমবার (১৫ জানুয়ারি) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এর আগের দিনই (১৪ জানুয়ারি) রাজধানীর বাড্ডা এলাকার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বন্ধের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। হাসপাতালটিতে পরিদর্শনে গিয়ে ওই হাসপাতালের লাইসেন্সসহ জরুরি কাগজপত্র পাওয়া যায়নি বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
রোববার (১৪ জানুয়ারি) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
এতে বলা হয়েছে, ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু আয়ান আহমেদের (৫+ বছর) মৃত্যুতে তার বাবার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তরের পরিচালকের (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) নেতৃত্বে ১০ জানুয়ারি হাসপাতালটি পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনকালে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রদত্ত লাইসেন্স দেখাতে ব্যর্থ হয়।
আরও পড়ুন
এছাড়া দপ্তরের অনলাইন ডাটাবেজ পর্যালোচনা এবং পরিদর্শনকালে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নামে কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিকট নিবন্ধন/লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য কখনোই অনলাইন আবেদন করেনি। এমনকি প্রতিষ্ঠানটি কোনো প্রকার আইনানুগ নিবন্ধন অথবা লাইসেন্স ব্যতিরেকে চিকিৎসা সেবা নির্মাণাধীন ভবনে পরিচালনা করে আসছে, যা সরকারের প্রচলিত আইনের পরিপন্থি। তাই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে হাসপাতালটি বন্ধের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
আয়ানের বাবার দায়ের করা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাড্ডা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইয়াসিন গাজী ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিশু আয়ানের বাবা মো. শামীম আহমেদ অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুই ডাক্তার ও পরিচালককে আসামি করা হয়েছে। মামলার আসামিদের মধ্যে আছেন এনেসথেসিয়া স্পেশালিস্ট ডা. সাইদ সাব্বির আহমেদ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. তাসনুবা মাহজাবিন এবং হাসপাতালের পরিচালক।
তিনি বলেন, মামলায় ভুল চিকিৎসা ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ প্রমাণে বিশেষায়িত তদন্ত ও বক্তব্য দরকার। সেজন্য আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়েছি। আদালতও স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত ও প্রতিবেদন দাখিলে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে আমরা এখন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিবেদন পাইনি। তদন্ত প্রতিবেদন পেলেই আমরা আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করব।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার পর গুরুত্ব বিবেচনায় আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। ১০ কার্য দিবস সময় দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে জানা যাবে মৃত্যুর কারণ। তবে পরিদর্শনে গিয়ে বৈধ কাগজপত্র না পাওয়ায় ইতোমধ্যে হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের চিঠি কিংবা আদালতের নির্দেশনার কপি পেয়েছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অফিসিয়াল কাজে আমি ঢাকার বাইরে আছি।পুলিশের চিঠি বা আদালতের নির্দেশনার কপি এসেছে কি না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।
তিনি বলেন, ঘটনার তদন্ত চলছে। আমরা ২/৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন হাতে পাব বলে আশা করছি। তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি থানা পুলিশের চিঠি বা আদালতের নির্দেশনার কপি পেলে যথাযথ জবাব দেওয়া হবে।
যোগাযোগ করা হলে আয়ানের চাচা মো. মানিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, শোকাহত পরিবার বরিশালে গ্রামের বাড়িতে আছে। এখন শোক কাটেনি। আয়ানের বাবা অসুস্থ। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
দায়ের করা মামলার এজাহারে ভিকটিমের বাবা অভিযোগ করে বলেন, আমার ছেলে আয়ান আহমেদ। তার বয়স ৫ বছর ৯ মাস। গত ৩০ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় আয়ান আহমেদের সুন্নতে খতনা করানোর জন্য সাঁতারকুল, মাদানি অ্যাভিনিউ রোডে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে যাই। যাওয়ার পর হাসপাতালের নিয়ম অনুসারে ভিজিট দিয়ে সিরিয়াল নিয়ে বেলা সাড়ে ১১টায় ডা. তাসনুভা মাহজাবিনের রুমে আমার ছেলেকে নিয়ে প্রবেশ করে সুন্নতে খতনা করানোর বিষয়ে আলোচনা করি। তখন তিনি আমার ছেলেকে দেখে বলেন আমরা নিয়মিতভাবে সুন্নতে খতনা করাই এবং সুন্নতে খতনার পূর্বে ওষুধ খাওয়ানোর ফলে বাচ্চার ১০-১৫ মিনিট ঘুমঘুম ভাব থাকে এ সময়ের মধ্যেই আমরা সেটি সম্পন্ন করি। এটাই সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি।
এনেসথেসিয়া স্পেশালিস্ট ডা. সাইদ সাব্বির আহম্মেদ ও ডা.তাসনুভা মাহজাবিন আমার ছেলের শারীরিক পরীক্ষার জন্য কিছু টেস্ট দেন এবং ওই টেস্টগুলোর রিপোর্টসহ ৩১ ডিসেম্বর সকালে আমাকে যেতে বলেন। পরে টেস্টগুলো করি ৩১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৮ টায় হাসপাতালে যাই।
পরে ডা. তাসনুভা মাহজাবিনকে আমার ছেলের শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্টগুলো দেখাই। তিনি রিপোর্টগুলো দেখে রিপোর্টগুলো ভালো আছে বলে জানান। পরে ডাক্তার সাব্বির ও তাসনুভা ৩১ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় নার্সদের সহযোগিতায় আমার ছেলে আয়ান আহমেদকে ওটি রুমে (অপারেশন রুম) রুমে নিয়ে যান। তারা আমাকে তখন ২০-২৫ মিনিট অপেক্ষা করতে বলেন।
এরই মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ জন ইন্টার্ন ডাক্তার ওটি ড্রেস পরে ওটি রুমে প্রবেশ করেন। আমি তাদের ওটি রুমে প্রবেশ করার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, ডাক্তার তাসনুভা মাহজাবিনের ক্লাস আছে।
২০/২৫ মিনিট পরে আমি জিজ্ঞাসা করলে আরও কিছু সময় লাগবে বলে সময় পার করতে থাকেন। এক ঘণ্টা পরে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা দ্রুত রুমে থেকে বের হয়ে চলে যান। তারা চলে যাওয়ার পরে আরও সময় লাগবে বলে কালক্ষেপণ করতে থাকে। তারপর দেড় ঘণ্টা পর হাসপাতালের বিভিন্ন ডাক্তার উদ্বিগ্ন হয়ে ওটি রুমে প্রবেশ করেন এবং বের হতে থাকেন। তখন আমরা বুঝতে পারি যে, কোনো একটা সমস্যা হয়েছে।
তখন আমি জোর করে ওটি রুমে প্রবেশ করে দেখি যে, ডাক্তাররা আমার ছেলের বুকে হাত দিয়ে চাপাচাপি করছেন এবং আমার অনুমতি ছাড়াই তারা আমার ছেলের বুকের দুই পাশে ফুটা করে টিউব স্থাপন করেন। এরপরেও কোনো কাজ না হওয়ায় তারা তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আমার ছেলেকে দ্রুত গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যান। তখন আমি আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য আমার ছেলেকে অন্য হাসপাতালে নিতে চাইলেও তারা আমার কথা না শুনে ওই হাসপাতালে নিয়ে যান।
এজাহারে তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, সেখানে নিয়ে আমার ছেলেকে লাইফ সাপোর্টে রাখেন তারা। আমি ৩১ ডিসেম্বর রাতে ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসিইউতে প্রবেশ করে আমার ছেলের দেহ শীতল ও নিথর অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। হাসপাতালের প্রতি আমাদের অনাস্থা বাড়তে থাকলে আমরা উন্নত চিকিৎসার জন্য আমার ছেলেকে অন্য কোনো হাসপাতালে নিতে চাইলে কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনো কথাই কর্ণপাত না করে জোর করে তাদের হাসপাতালেই চিকিৎসা প্রদান করে।
তিনি বলেন, আসামিদের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার কারণেই আমার ছেলের মৃত্যু হয়। আমার ছেলেকে কী ধরনের চিকিৎসা বা ওষুধ প্রয়োগ করেছে তা তারা অদ্যাবধি পর্যন্ত আমাদের সরবরাহ করেনি। আমার ছেলেকে দেখতে চাইলে নানা তালবাহানা করে ঠিক মতো দেখতে দিতো না। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অধিক লাভবান হওয়ার জন্য আমার ছেলেকে ৩১ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ইউনাইটেড হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রেখে অবহেলামূলকভাবে ভুল চিকিৎসা প্রদান করায় আমার ছেলের মৃত্যু হয়। অতঃপর তারা আমার ছেলেকে মৃত ঘোষণা করে আমার ছেলের মৃতদেহসহ ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৫৭ টাকার একটা বিল ধরিয়ে দেয়।
জেইউ/এসকেডি