বিরোধী দল কে, জাতীয় পার্টি নাকি স্বতন্ত্র?
- আওয়ামী লীগ ২২২, জাতীয় পার্টি ১১, স্বতন্ত্র ৬২, অন্যান্য ৩, স্থগিত ২ আসন
- বিরোধী দলের নেতা জি এম কাদের নাকি লতিফ সিদ্দিকী?
- বিরোধী দল কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনের বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা নেই
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ৭ জানুয়ারি। এই নির্বাচনে ২৯৮ আসনের (২টি আসন স্থগিত) মধ্যে ২২২টিতে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। আর বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) মাত্র ১১টি আসনে জয় পেয়েছে। জাপাকে পেছনে ফেলে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে। যদিও স্বতন্ত্র জয়ীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের (৫৮ জন)। এ অবস্থায় জাতীয় সংসদের বিরোধী দল কারা হবে, আর বিরোধী দলীয় নেতাই বা কে হচ্ছেন তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
সংসদে বিরোধী দল কিংবা বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচনের বিষয়ে দেশের সংবিধানে কিছু বলা নেই। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সংসদের স্পিকারের। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২(১)(ট)-তে বলা বলা হয়েছে, ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ বলতে স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত, ক্ষেত্রমতে দল বা অধিসঙ্গের নেতা।
আরও পড়ুন
নির্বাচনে জয়ের পরদিন সোমবার বিকেলে গণভবনে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করেন শেখ হাসিনা। সেখানে বিদেশি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনি কি চান আমি একটি বিরোধী দল গঠন করি? আমি তা করতে পারি? আমি নিজেও বিরোধী দলে ছিলাম দীর্ঘ সময়। আমরা আমাদের দল গঠন করেছি। বিরোধীদেরও তা করতে হবে। আপনি যদি তা করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার জন্য কে দায়ী?’
লাঙ্গলে প্রতীকে জয়ী ১১টি আসন নিয়ে দৃশ্যত আবারও সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসতে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। তবে সংখ্যায় স্বতন্ত্ররা পাঁচগুণ বেশি হওয়ায় জাতীয় পার্টির বিরোধী দলের আসনে বসাটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগের মতো স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় পাওয়ায় আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ঐক্য করলে তারাও বিরোধী দল হতে পারে। আবার বিরোধী দলের আসনে কারা বসছে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘লিডার অব দ্য হাউস অর্থাৎ যিনি নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন, তিনিই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
আরও পড়ুন
জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা; তারা জিতেছেন মোট ৬২ আসনে। আর গত দুই সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১ আসন। এর বাইরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি এবং এক সময় বিএনপির জোটে থাকা কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয় পেয়েছে। লাঙ্গলে প্রতীকে জয়ী ১১টি আসন নিয়ে দৃশ্যত আবারও সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসতে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। তবে সংখ্যায় স্বতন্ত্ররা পাঁচগুণ বেশি হওয়ায় জাতীয় পার্টির বিরোধী দলের আসনে বসাটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৬২ জন হলেও তারা একা একা, সেজন্য তাদের আর বিরোধী দল হওয়ার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি অন্য যে দলগুলো নির্বাচিত হয়েছে, তাদের মধ্যে যে কোনো দলকে সমর্থন দিতে পারে। যে দলের সমর্থন বেশি তারাই হবে বিরোধী দল। আর যদি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে আলাদাভাবে কোয়ালিশন করতে পারে, তখন ওই কোয়ালিশন করাদের নিয়ে কতজন হবে, সেই হিসেবে তারাও বিরোধী দল হতে পারে।
জানা যায়, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই পেয়েছিল ২৯৩টি আসন। আর বিরোধী ছোট ছোট কয়েকটি দল মিলে পেয়েছিল বাকি সাতটি আসন। সেসময় এসব দল যৌথভাবে বাংলাদেশ জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খানকে তাদের নেতা উল্লেখ করে বিরোধী দলের নেতার মর্যাদা দেওয়ার জন্য স্পিকারের কাছে আবেদন জানান। তবে তৎকালীন সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাতে আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে একটি রাজনৈতিক দলের অবশ্যই কমপক্ষে ২৫টি আসন থাকতে হবে। না হলে তাদের পার্লামেন্টারি গ্রুপ হিসেবে বলা যেতে পারে, কিন্তু বিরোধী দল নয়।
তৎকালীন সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাতে আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে একটি রাজনৈতিক দলের অবশ্যই কমপক্ষে ২৫টি আসন থাকতে হবে। না হলে তাদের পার্লামেন্টারি গ্রুপ হিসেবে বলা যেতে পারে, কিন্তু বিরোধী দল নয়।
আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক কাজী নজিবুল্লা হিরু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী যারা আছেন, এরা সবাই এখন একক। এরা সবাই মিলে যদি একটা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে আসতে পারে বা কোনো ঐক্য করতে পারে তখন এটা ইন্ডিভিজুয়াল থেকে কালেকটিভে আসবে। তখন যদি দ্বিতীয় মেজরিটি তারা গঠন করতে পারে সে ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিরোধী দল হিসেবে দাবি করতে পারবে। তখন সংসদে তারাই বিরোধী দল হবে।’
দলীয় সূত্র মতে, টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে ট্রাক প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডুকে পরাজিত করে জয়ী হয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিক নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। লতিফ সিদ্দিকী কালিহাতী আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এক সময়ে মন্ত্রীও হয়েছেন। হজ নিয়ে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর পদ হারান তিনি। পরে মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ পড়েন এবং সবশেষে দল থেকে বহিষ্কৃত হন। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অনুষ্ঠান থেকে দূরে ছিলেন। এই নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ছোট ভাই কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে এক মঞ্চে ওঠেন লতিফ সিদ্দিকী। এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নির্বাচনী মাঠে প্রচারণা চালান। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মেজরিটি গঠন করতে পারলে এই সিনিয়র নেতা বিরোধী দলের নেতা হতে পারেন বলে জানান দলের নেতারা।
এদিকে গত দুই সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১ আসন। রংপুর-৩ (সদর ও সিটি করপোরেশন) আসনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী জিএম কাদের। দলীয় প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয় থাকার কারণে সংসদে বিরোধী দল ও বিরোধী নেতার বাছাইয়ের দৌড়ে রয়েছে জাতীয় পার্টি। সে কারণে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা হতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকেই।
এমএসআই/এসএম