হিন্দির মৃত্যুতে ত্রুটি ইউনাইটেডের, তদন্তে অসহযোগিতা গালফ এয়ারের
· অনুপস্থিত চিকিৎসকের অধীনে রোগী ভর্তি নেয় ইউনাইটেড হাসপাতাল
· তদন্ত কর্মকর্তাকে পাল্টা প্রশ্ন গালফ এয়ারের কান্ট্রি ম্যানেজারের
· গোটা তদন্তে গালফ এয়ারের আচরণ ছিল নেতিবাচক
· ইউনাইটেডের বিষয়ে চুপ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিএমডিসি
· সহযোগিতা করেনি শাহজালাল বিমানবন্দর ও বেবিচক
গালফ এয়ারের পাইলট ক্যাপ্টেন মোহান্নাদ ইউসেফ হাসান আল হিন্দির মৃত্যু নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি আদালতে জমা দিয়েছে পিবিআই। প্রতিবেদনে পাইলটের পরিবারের করা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও হিন্দির মৃত্যুতে ইউনাইটেড হাসপাতালের প্রক্রিয়াগত অসঙ্গতি এবং মামলার তদন্তে গালফ এয়ারের অসহযোগিতার কথা উঠে এসেছে।
২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন মোহান্নাদ হাসান আল হিন্দি ডিউটিরত এবং ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি মারা যান।
হিন্দি ইউনাইটেড হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিনের চিফ কনসালট্যান্ট ডা. মো. ওমর ফারুকের অধীনে ভর্তি হয়েছিলেন। মোহান্নাদের বোন তালা আল হিন্দি জোসেফানো ডা. ফারুককে অভিযুক্ত করে গত বছরের মার্চ মাসে ঢাকার সিএমএম আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন।
আরও পড়ুন
আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কলেজকে (বিএমডিসি) ঘটনাটি তদন্ত করে আলাদা আলাদা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
ইউনাইটেড হাসপাতালের বিষয়ে তদন্তে যা এসেছে
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গালফ এয়ারের পাইলটকে ঘটনার দিন ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে ইউনাইটেড হাসপাতালে প্রফেসর মো. ওমর ফারুকের অধীনে ভর্তি করা হয়। তবে তখন তিনি হাসপাতালে ছিলেন না। ভর্তির পর পাইলটকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। ডা. ফারুক সকাল সাড়ে ৯টায় হাসপাতালে এসে পাইলটের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তারা অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন। তবে বিভিন্ন টেস্ট করার সময় দুপুর ১২টা ৮ মিনিটে পাইলট হাসান আল হিন্দি মারা যান। ওমর ফারুকের অনুপস্থিতিতে তার অধীনে (ভোরে) কীভাবে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা হলো এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো উত্তর দিতে পারেননি ওই চিকিৎসক।
ওই ঘটনার ৫ মাস পর ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে ঘটনার দিনের সাড়ে ৮ ঘণ্টার সিসিটিভি ফুটেজ চেয়ে আবেদন করা হয়। তবে এক চিঠিতে তারা জানায়, ইউনাইটেড হাসপাতালের সার্ভারে ৩০ দিনের বেশি সিসিটিভি ফুটেজ থাকে না।
পিবিআই ইউনাইটেডের কাছে জানতে চায়, একজন চিকিৎসকের অধীনে কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে সেই চিকিৎসক যদি হাসপাতালে না থাকেন তাহলে ওই রোগীর চিকিৎসার জন্য কী ধরনের প্রটোকল ব্যবহার করা হয়? এ বিষয়ে পিবিআই'র পক্ষ থেকে ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে জানতে চাইলে তারা জানায়, এ বিষয়ে তাদের কোনো বিধি, প্রোটোকল বা কনভেনশন নেই।
তবে ‘বারডেমসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এই প্রোটোকল রয়েছে’ বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে পিবিআই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মৃত ব্যক্তির মৃত্যু সনদে হার্টে ৯৯ শতাংশ ব্লকেড থাকা সত্ত্বেও সকাল ৮টা পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরও ইউনাইটেড হাসপাতালের জুনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ডা. তুনাজ্জিনা আফরিন রোগীর হার্টে কোনো ধরনের সমস্যা নেই বলে মন্তব্য করেছেন। শুধু তাই নয়, সকাল ৮টায় ডাক্তার আফরিন রোগীর খোঁজ-খবর নিতে সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট বা কোনো পরামর্শককে না জানিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেন।
ইউনাইটেড হাসপাতালের বিষয়ে ‘মতামত দেয়নি’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিএমডিসি
পিবিআইয়ের তদন্তে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিভিন্ন অসঙ্গতি পাওয়া গেলেও এ বিষয়ে মতামত দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। পিবিআই জানায়, তাদের পক্ষ থেকে ইউনাইটেড হাসপাতাল ও এর চিকিৎসকদের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়ে মতামত জানতে চেয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল-বিএমডিসির সভাপতির কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়। আদালত বিএমডিসিকে একাধিকবার নির্দেশ নিলেও তারা কোনো মতামত দেয়নি। তাদের মতামত না পাওয়ায় ইউনাইটেড হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করা যায়নি।
এছাড়া পিবিআই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে জানতে চায়, ডাক্তার অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও সেই ডাক্তারের অধীনে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা যায় কি না? পাশাপাশি ইউনাইটেড হাসপাতালের মতো একটি ব্যয়বহুল হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা বিশেষ চিকিৎসা দেওয়ার কথা রয়েছে। তবে ভোর ৫টায় ভর্তি হওয়া একজন গুরুতর রোগীকে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে পারকিউটেনাস করোনারি ইন্টারভেশন (পিসিআই) করা হয়। এ বিষয়ে আপনার মতামত প্রয়োজন। কিন্তু ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেয়নি।
‘তাই চিকিৎসা প্রদানকালে ডাক্তারদের অবহেলা ও হাসপাতালের রেকর্ডে জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণ করা সম্ভব হলো না’, বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করে পিবিআই।
সাক্ষীকে ‘লুকিয়ে’ দায় এড়িয়েছে গালফ এয়ার
পিবিআই’র তদন্তে বলা হয়েছে, গালফের কো-পাইলট খলিল আব্দুর রাজ্জাক ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভিকটিমের সঙ্গে ছিলেন, ইউনাইটেড হাসপাতালে অবস্থান করেছেন, এমনকি মরদেহ জর্ডানে হস্তান্তর করেন। তিনি মামলার সাক্ষী। তবে গালফ এয়ার তাকে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হাজির করা থেকে বিরত রেখেছেন।
পিবিআই বলছে, রাজ্জাকের মোবাইল ফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ-ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি, জবাবও দেননি। তবে একাধিকবার চিঠি দেওয়ার পর গালফ এয়ার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কো-পাইলট খলিল আব্দুর রাজ্জাক পিবিআইকে একটি লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। সেই লিখিত বক্তব্য আদৌ রাজ্জাকের বক্তব্য কি না তা নিশ্চিত হতে পারেনি পিবিআই।
গালফের কান্ট্রি ম্যানেজারের বিষয়ে তদন্তে বলা হয়েছে, মামলার তদন্তকালে গালফ এয়ারের কান্ট্রি ম্যানেজার ঈসা শাহকে তদন্তকারী কর্মকর্তা বক্তব্য দেওয়ার জন্য একটি নোটিশ দেন। ঈসা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন তাকে ডাকা হয়েছে’?
পিবিআই উল্লেখ করেছে, গালফ এয়ারের সাক্ষীদের পিবিআইয়ের কাছে হাজির করানো এবং ভিকটিমের মেডিকেল রেকর্ড সংগ্রহ করে পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার, গালফ এয়ার এবং তার অফিসে কর্মরত ব্যক্তিরা সবসময় নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। নানা অযুহাতে কালক্ষেপণ করে সাক্ষী ও মেডিকেল রেকর্ড পাঠানো থেকে বিরত থেকেছেন। তাদের একজন সহকর্মীর মৃত্যুর তদন্ত কার্যেও তারা কোনোরকম সহযোগিতা করেননি।
তদন্তকালে জানা যায়, গালফ এয়ার কর্তৃপক্ষ রোগীর মরদেহের কোনো ময়নাতদন্ত বা সুরতহাল করেনি। এ বিষয়ে হিন্দির কো-পাইলট কোনো বক্তব্য দেননি। মরদেহ বুঝে নেওয়া কান্ট্রি ম্যানেজার ঈসা শাহও কোনো বক্তব্য দেননি।
সহযোগিতা করেনি শাহজালাল বিমানবন্দর ও বেবিচকও
পিবিআই প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই ঘটনার তদন্তে একাধিকবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক ও সিভিল এভিয়েশনের কাছে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ও অভ্যন্তরীণ তদন্তের প্রতিবেদন চাইলে তারা কোনো উত্তর প্রদান করেননি। তাই বিমানবন্দরে ক্যাপ্টেন হিন্দির সঙ্গে কোনো অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল কি না তা জানা যায়নি।
‘বিচারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাব’
পিবিআইয়ের প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে পাইলট মোহান্নাদের বোন তালা এল হিন্দি জোসেফানো ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যথেষ্ট প্রমাণ উন্মোচিত হওয়া সত্ত্বেও কোনো অপরাধ প্রমাণিত হয়নি বলে তদন্তকারী কর্মকর্তা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তাতে আমাদের পরিবার হতাশ ও মর্মাহত।’
তিনি জানান, নিহত হিন্দির পরিবার জানতে পেরেছে যে, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং তার পরিবারকে ক্ষতি করার হুমকি দেওয়া হয়েছে বারবার, যা মোহান্নাদের মৃত্যুর ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের ক্ষেত্রে বাধা ও অবৈধ হস্তক্ষেপ সৃষ্টি করেছে। পরিবারটির ধারণা, গালফ এয়ার এবং ইউনাইটেড হাসপাতাল মোহান্নাদের মৃত্যুতে তাদের দোষ ঢাকতে একসঙ্গে কাজ করছে।
জোসেফানো বলেন, ‘যতদিন না মোহান্নাদের আকস্মিক মৃত্যুতে জড়িত দোষী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত হয়, ততদিন তার পরিবার তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে চায়। ভিকটিমের মৃত্যুতে জড়িত অপরাধী তথা যেসব ডাক্তার চিকিৎসাজনিত অবহেলায় জড়িত তারা জেলে না যাওয়া পর্যন্ত এবং দায়ী গালফ এয়ার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।’
এআর/জেডএস