সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রতিবন্ধকতা তুলে দিতে হবে
শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, আমি সরকারে থাকি বা না থাকি যেকোনো সরকারি চাকরিজীবীর ক্ষেত্রে শৃঙ্খলাজনিত প্রক্রিয়ার বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হবে। রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সাংবাদিকরা যা খুশি লিখতে পারেন। এটিই বাকস্বাধীনতা। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনও চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সেটি একজন সরকারি দপ্তরের চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে করতে গেলে অনেক কঠিন। এ বিষয়টি আমাদের তুলে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। সরকারি একজন কর্মচারী-কর্মকর্তার আচার ব্যবহার ও দক্ষতার ওপর কিন্তু জনগণের সন্তুষ্টি নির্ভর করে।
মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম সিনিয়রস ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন। শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৯ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনে সোমবার রিটার্নিং কার্যালয় থেকে প্রতীক পেয়ে ইতোমধ্যে প্রচারণাও শুরু করেছেন তিনি।
উপমন্ত্রী আরও বলেন, ডা. দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি। কিন্তু তার পক্ষেও একজন শিক্ষক-দপ্তরি বা কাউকে শৃঙ্খলার আওতায় আনা কঠিন কাজ। সে বিষয়টি নিয়ে একটি নিয়মের মধ্যে না আসলে কেউ পারবে না। জেলা প্রশাসকও পারবেন না। একদিন দেখা যাবে জেলা প্রশাসকও বদলি হয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে আমরা গণমাধ্যমের সহযোগিতা চাই। কেন একজন সরকারি চাকরিজীবী সব ধরনের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকবেন? কেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারব না? আমাদের গড়ে ৪ থেকে ৫ বছর লাগে বিভাগীয় মামলা শেষ করতে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের ব্যারিয়ারটা তুলে দিতে হবে। তাদের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার জায়গাটা আরেকটু সহজ করতে হবে।
এসময় নওফেল বলেন, আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকের সংকট রয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। আমাকে একটি বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে পীড়া দেয়। আমি শতভাগ আত্মসমর্পণ না করলেও পরাজিতের মত অনুভব আছে। পরাজিত কেন? বাংলাদেশ সরকারের একটা বিশাল বাজেট শিক্ষা খাতের ওপর খরচ হয়। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন। কিছু কাঠামোগত বিষয়ে আমাদের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের শৃঙ্খলাজনিত প্রক্রিয়া সেটি এমনই যে, মন্ত্রীর পর মন্ত্রী চলে যাবে কিন্তু আপনি একজন দপ্তরিকেও সরাতে পারবেন না।
শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রামে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপনের প্রস্তাব করেছি। এটা সংবিধানেও আছে। সেটা করলে আমাদের চট্টগ্রাম নয়, সারা দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে যারা বিচারপ্রার্থী রয়েছেন, তাদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সহায়ক হবে। বর্তমান যে কাঠামো, সেখানে আমরা জানি কারও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হলে, বিত্তশালী হলে ঢাকায় গিয়ে রিট করে প্রতিকার পায়। কিন্তু বিত্তশালী না হলে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি সাংবিধানিক অধিকার, সেক্ষেত্রে অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, ব্যাংক, বিমাসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক সরকারি সদর দপ্তরের সদর দপ্তর ঢাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা সার্কুলার রয়েছে, ব্যাংকের সদর দপ্তর ঢাকায় হতে হবে। এটা বেশ অন্যায্য। প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে দপ্তর স্থাপন করতে পারে। সেক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের পরিধিও বাড়বে।
শহরের এমপিদের বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে ৩০০ জন এমপির মধ্যে ২০ জন শহরের এমপি রয়েছেন অর্থাৎ যারা সিটি কর্পোরেশন এলাকার। অন্যান্য ২৮০ জন যেসব বরাদ্দ পান শহরের এমপিরা তা পান না। এটা খুবই অমানবিক এবং অন্যায্য। অন্যান্য এমপির মতো কিছু বরাদ্দ পেলে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে হোক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হোক উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া যেত। এটি অবশ্য ইশতেহারের বিষয় নয়, আমি আলাদাভাবে বলেছি।
নওফেল বলেন, আমরা দেখছি প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু নিম্ন মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শুধু ৭০০ সরকারি বিদ্যালয় রয়েছে। বাকি ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠান বেসরকারি। অর্থাৎ যেখানে বেতন দিয়ে পরিশোধ করে পড়াশুনা করতে হয়। সেটি কিন্তু জাতির পিতার শিক্ষানীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা দেখছি প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণে আমরা প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ এনরোলমেন্ট হচ্ছে। কিন্তু ১০ থেকে ১১ বছর বয়সে প্রাথমিকের পর্যায় শেষ হয়ে যায়। এ সময় অনেক শিশুর মস্তিষ্কের ভালোভাবে বিকাশ ঘটে না। তারপরে তাদেরকে ভর্তিযুদ্ধ নামে একটা অমানবিক প্রতিযোগিতায় মুখোমুখি হতে হতো। সেটি আমরা মোটামুটি নিরসন করতে পেরেছি।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের একটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেটি হচ্ছে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। সেটির বিষয়ে সাংগঠনিকদের কোনো প্রস্তাবনা থাকলেও জানাবেন। কিন্তু কিছু বিষয় আসলে ইশতেহারের মাধ্যমে সম্ভব না। যেমন সিটি গভর্নমেন্টের আদলে কিন্তু একটা লিগ্যাল স্ট্রাকচার তৈরি হয়েছে সিটি কর্পোরেশন আইনের মধ্যে। যেখানে অন্যান্য সেবা সংস্থার প্রতিনিধিত্ব সাধারণ সভার মাধ্যমে আনার একটা স্ট্রাকচার আছে। কিন্তু বাস্তবে কাজ করতে গিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় এবং নির্বাচিত মেয়ররাই বেশি সমালোচনার শিকার হন।
'কিন্তু সেক্ষেত্রে মেয়রের সমন্বয়ে ক্ষেত্রে লিগ্যাল ক্যাপাসিটির ঘাটতি সেটি আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমরা কিছুটা কাজ করেছি শিক্ষার ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিকেন্দ্রীকরণ করতে পেরেছি। অন্যান্য ক্ষেত্রে কীভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়, যাতে স্থানীয়ভাবে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়। চাকরির জন্য সবাই ঢাকামুখী না হয়। আমাদের এবার সুপারিশকৃত স্লোগান- উন্নয়ন হয়েছে দৃশ্যমান, এবার হবে কর্মসংস্থান।'
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) গ্রুপিং নিয়ে উপমন্ত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ১০ বছরের বেশি আন্ডার গ্র্যাজুয়েটে থেকে গেছেন, তারা ছাত্র না। যেহেতু তারা ছাত্র না, তাদেরকে বের করে দিতে হবে। তারা শিক্ষার আশেপাশে নেই। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থেকে তারা গ্রুপ তৈরি করে। নেতার নাম ব্যবহার করে। তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, আমি জানি না। আমি এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স। মৌখিকভাবে বলেছি নির্বাচনের পরে লিখিতভাবে জানাব।
এসময় চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ. জ. ম নাছির উদ্দীনসহ নগর আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মহানগর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী।
এমআর/পিএইচ