রেকর্ড সংখ্যক কর্মী বিদেশে, তবুও সুবাতাস মিলছে না রেমিটেন্সে
মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন তিন বছর ধরে সৌদি আরব রয়েছেন। পেশায় নির্মাণ শ্রমিক বাতেনের প্রতি মাসে পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতে হয়। ব্যাংকের ঝক্কি এড়াতে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান তিনি। সৌদির দাম্মার শহরে থাকা বাতেনের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় ঢাকা পোস্টের।
বাতেন বলেন, ‘এখানে আসার পর প্রথম প্রথম ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতাম। কিন্তু ব্যাংক দিয়ে টাকা পাঠাতে গেলে অনেক ঝামেলা। অফিস থেকে ছুটি নাও, আরও কত কি। হুন্ডিতে টাকা দিলে বাড়িতে সরাসরি পৌঁছে দেয়। আর লাভও বেশি। কষ্ট করে আয় করি। দুইটা টাকা বাঁচাতে কে না চাইবে?’
চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড সংখ্যক কর্মী/শ্রমিক বিদেশে গেছেন। এ সময়ে ১২ লাখ ১০ হাজার ২৫৬ কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থানে হয়েছে। প্রতি বছর নতুন কর্মী যুক্ত হচ্ছে। তবে যে পরিমাণে কর্মীর কর্মসংস্থান হচ্ছে সে তুলনায় প্রবাসীদের আয় (রেমিটেন্স) বাড়ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বরে প্রবাসীরা ১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। গত বছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল ১ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক মাস আগের তুলনায় নভেম্বরে প্রবাসী আয় ২ দশমিক ৪২ শতাংশ কমেছে।
অক্টোবরে প্রবাসী আয় এসেছে ১ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার, যা চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছরের একই মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ১ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার।
অগাস্ট মাস শেষে প্রায় ১৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অথচ গত বছর এই মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় অগাস্ট মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২১.৪৮ শতাংশ।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রবাসীরা ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ মার্কিন ডলার বৈধ পথে ও ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।
গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় এবার জুলাইয়ে প্রবাসী আয় কমেছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এপ্রিল এবং মে মাসেও রেমিট্যান্স অনেক কম এসেছিল। তবে ঈদের মাস জুনে ২.২০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে।
‘এখানে আসার পর প্রথম প্রথম ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতাম। কিন্তু ব্যাংক দিয়ে টাকা পাঠাতে গেলে অনেক ঝামেলা। অফিস থেকে ছুটি নাও, আরও কত কি। হুন্ডিতে টাকা দিলে বাড়িতে সরাসরি পৌঁছে দেয়। আর লাভও বেশি। কষ্ট করে আয় করি। দুইটা টাকা বাঁচাতে কে না চাইবে?’
প্রবাসী খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব মিলিয়ে বিদেশে বাংলাদেশের ২ কোটি ১১ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। এর বাইরে শিক্ষার্থী, অবৈধ কর্মী এবং অনিবাসী বাংলাদেশি মিলিয়ে অর্ধ কোটির মতো মানুষ বিভিন্ন দেশে রয়েছেন, যাদের অধিকাংশই দেশে টাকা পাঠান। তবে সেই অর্থে দেশে রেমিটেন্স অনেক কম আসছে।
রেমিটেন্স কম আসার কারণ হিসেবে তাদের ভাষ্য, প্রতি বছর বিদেশে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা বাড়লেও সেভাবে রেমিট্যান্স বাড়েনি। এ জন্য হুন্ডি মোটা দাগে দায়ী। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্ক দুর্গম অঞ্চলেও বিস্তৃত। তারা অভিবাসীদের স্বল্প সময়ে ও খরচে দেশে টাকা পাঠানোর নিশ্চয়তা দেয়।
তবে হুন্ডি বন্ধে সেই অর্থে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। পাশাপাশি সহজে ও ন্যায্য মুদ্রা বিনিময় মূল্যে শ্রমিকেরা যাতে দেশে অর্থ পাঠাতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। এছাড়া ব্যাংক বা মানি এক্সচেঞ্জ হাউস মূলত কর্মস্থল থেকে দূরে হওয়ায় অর্থ পাঠাতে কর্মীদের ছুটি নিতে হয়। এতে যাতায়াত খরচও হয়। ফলে ব্যাংক বা মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গেলে কর্মীদের আর্থিক ক্ষতি হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ছুটি নিলে মজুরি কেটে রাখে।
জানতে চাইলে রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কর্মী যাওয়া, রেমিটেন্স আসা দুটো দুই জিনিস। এটা তো হওয়ার কথা ছিল যত কর্মী যাবে তত রেমিটেন্স আসবে। যারা বিদেশ যায় তারা কিন্তু টাকা পাঠায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা টাকাটা কিভাবে পাঠায় বা মাধ্যমটা কি? রেমিটেন্স হিসেবে সেটাই দেখতে পাই যেটা ব্যাংকিং চ্যানেলে আসে— অন্য কোনো মাধ্যমে সেটা রেমিটেন্স দেখা যায় না। গত তিন বছরে প্রায় ৩০ লাখের ওপর কর্মী বিদেশ গেছেন। এটা যদি হয়ে থাকে তাহলে তো রেমিটেন্স আনুপাতিক হারে বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা কম দেখতে পাচ্ছি।’
শামীম আহমেদ আরও বলেন, ‘সরকার প্রণোদনা বাড়িয়েছে, যার কারণে গত কয়েক মাস ধরে কিন্তু রেমিটেন্স বাড়ছে। তবে যে পরিমাণ মানুষ বিদেশ যাচ্ছে, তার রেমিটেন্স যদি পেতে হয় ব্যাংককে আস্থা অর্জন করতে হবে। ব্যাংককে আরও সুবিধা দিতে হবে। যাদের টাকা চাইছেন তারা কেন আপনাকে টাকা দেবেন? সেজন্য মার্কেট সমপরিমাণ তাদের রেট দিতে হবে। তাদের জন্য বিভিন্ন ধরণের স্কিম চালু করা যেতে পারে। যেখানে প্রবাসীরা দু’টাকা বেশি পাবেন সেখানেই যাবেন। ব্যাংকগুলোকে স্কিম নিতে হবে।’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছর (২০২২) বাংলাদেশে থেকে বিদেশে গেছে ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী। ওই বছর রেমিটেন্স এসেছে ২ হাজার ১২৮ কোটি ডলার। ২০২১ সালে ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন বিদেশ যান, ওই বছর রেমিটেন্স আসে ২ হাজার ২০৭ কোটি ডলার। ২০২০ সালে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন বিদেশ যান, রেমিটেন্স আসে ২ হাজার ১৭৫ কোটি ডলার। ২০১৯ সালে বিদেশ গেছে ৭ লাখ ১৫৯ জন, রেমিটেন্স এসেছে ১ হাজার ৮৩৫ কোটি ডলার।
প্রবাসী আয়ের ওপর দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। তারপরেও রেমিট্যান্স কম আসার কারণ জানতে চাইলে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘এটার একটা বড় জায়গা হচ্ছে-আমাদের বেশিরভাগ লোক কম দক্ষ এবং কম বেতনে বিদেশ যায়। প্রফেশনাল দক্ষতা বা টেকনিক্যাল দক্ষতা কম থাকায় তারা কম বেতনে যেতে রাজি হচ্ছেন। আমাদের দেশের মানুষ যে পরিমাণে বিদেশ যাচ্ছেন সে পরিমাণে রেমিটেন্স আসছে না। এছাড়া অনিয়মিত জায়গা রয়ে গেছে, অনেকে টুরিস্ট ভিসা নিয়ে যাচ্ছে। সংখ্যাটা আসে এতজন গেল কিন্তু সবাই যে ওয়ার্ক পারমিট পেয়ে বা জবে যাচ্ছে বিষয়টা কিন্তু ওই রকম নয়।’
আসিফ মুনীর আরও বলেন, ‘আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বৈধ চ্যানেলে সবাই পাঠাচ্ছেন না বা পাঠাতে চাচ্ছেন না। সে কারণে সেটা রেমিটেন্সে দেখাচ্ছে না। যদি হুন্ডি করে পাঠায় সেটা কন্ট্রোল করাও মুশকিল। তবে এটার উপায় যে নাই এমনটাও নয়। খুব সহজে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেও এটা সম্ভব। ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে। হুন্ডিতে টাকা আসছে কিন্তু সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এমন কিছু সুবিধা দিতে হবে যেন প্রবাসীরা অবৈধ চ্যানেলে না পাঠিয়ে বৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠান।’
এনআই/এমটিআই