যুদ্ধ করে মেলে আইসিইউ, তবু স্বস্তি দিচ্ছে না করোনা
করোনায় আক্রান্ত হলে কী করবেন? কোন হাসপাতালে যাবেন? মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের চেয়ে উচ্চবিত্তদের এ চিন্তাটা অনেক বেশি। অনেকে পরিবারের সদস্য আক্রান্ত হবেন- এমন আশঙ্কায় আগে থেকেই প্রাইভেট হাসপাতালে কেবিন ও আইসিইউ বেড বুকিং দিয়ে রাখছেন।
বেসরকারি হাসপাতাল বেছে নেওয়া এমন অনেকের বিশ্বাস, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বিএসএমএমইউ) সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ পেতে হলে প্রয়োজন হয় উচ্চমহলের লবিং।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের কোভিড-১৯ ইউনিটে (পুরাতন বার্ন ইউনিট) দেখা হয়েছে তেমনি একজনের সঙ্গে। সরকারের সচিব সমমর্যাদার একজনের সুপারিশে তিনি বেড পেয়েছেন আইসিইউতে। তবে আইসিইউ পেলেও করোনার সঙ্গে হার মানতে চলেছেন ওই রোগী। এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
ঢামেক বার্ন ইউনিটের ৩ নম্বর বেডের রোগী আমিনুর। ৫০ বছর বয়সী আমিনুর টাঙ্গাইলের সরকারি স্কুলের শিক্ষক। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আমিনুরের বিষয়ে কথা হয় তার জামাতার সঙ্গে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এপ্রিল মাসের প্রথম দিন থেকেই শ্বশুরের করোনার উপসর্গ ছিল। ঢাকায় এনে তাকে আমরা ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যাই। ‘আইসিইউ নেই’ বলে সেখানে তারা রাখল না। স্কয়ার হাসপাতালের একজন সিনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম টাঙ্গাইল থেকেই। তিনি জানালেন, আইসিইউ নেই। ২ এপ্রিল হঠাৎ তার ফোন এলো। ফোনে বললেন, ‘চিকিৎসকদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে দেখলাম একজন আইসিইউ’র রোগী মারা গেছেন। একটা বেড খালি হয়েছে। দ্রুত আপনার রোগীকে নিয়ে আসেন।’ ফোন পেয়েই আমরা চলে গেলাম স্কয়ার হাসপাতালে। ২ দিনে সেখানে বিল হলো ৩ লাখ টাকা। স্কয়ারের বিল শুনেই ঢামেকের আইসিইউ’র জন্য যোগাযোগ করা শুরু করি। একজন স্বনামধন্য ব্যক্তির সুপারিশে আইসিইউতে বেড পাই। ৫ তারিখ থেকে এখানেই আছি। তবে আমার শ্বশুর বর্তমানে লাইফ সাপোর্টে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
তিনি বলেন, আমার শ্বশুরের অন্য কোনো রোগ নেই। শুধু করোনায় কাবু। ৪-৫ দিন এদিক ওদিক ঘুরে আইসিইউ পেয়েছি। তবু কাজ হচ্ছে না।
ঢামেকের আইসিইউতে থাকা এমন ৪ জনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তাদের প্রত্যেকেই বললেন আইসিইউ থেকে তাদের স্বজনদের ফিরে আসার সম্ভাবনা কম।
শেরপুরের আনোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী গত ১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। দুজন ভর্তি ছিলেন স্থানীয় একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে। তার পরিবারে জাতীয় দলের সাবেক একজন ক্রিকেটার থাকায় তিনি দুজনের জন্য মিরপুরের হার্ট ফাউন্ডেশনে দুটি আইসিইউ’র ব্যবস্থা করেন। ৬ এপ্রিল ঢাকায় আনা হয় তাদের। আইসিইউ’র পাশাপাশি দুটি বেডে ভর্তি হন তারা। স্ত্রী গত ৯ এপ্রিল মারা যান। পরিবারের অর্ধেক লোক মরদেহ নিয়ে চলে যান শেরপুরে, বাকীরা থাকেন ঢাকায় হাসপাতালে। পরদিন পরিবারের লোকজন অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় ফেরেন। ১১ তারিখ প্রাণ হারান স্বামী। এদিন দুপুরে তার মরদেহ নিয়ে গোটা পরিবার আবার রওনা হয় শেরপুর।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় আনোয়ারের ভাতিজা রোহানের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পরিবারটাতে হঠাৎ করেই শোকের ছায়া নেমেছে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমরা আইসিইউ ব্যবস্থা করেছি, তাতেও কাজ হচ্ছে না। সবার উচিৎ এখন থেকেই সচেতন হওয়া। কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছে না।
সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ নেই
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে থাকা ১২৯টি আইসিইউ’র মধ্যে রোববার (১১ এপ্রিল) বিকেল পর্যন্ত মাত্র ৩টি খালি ছিল। একটি মুগদা মেডিকেলে আর দুটি রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে। প্রাইভেট হাসপাতালে ৩৭৭টি আইসিইউ’র মধ্যে খালি রয়েছে মাত্র ৭টি।
মায়ান হাসান নামে পুরান ঢাকার একজন ব্যবসায়ী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবার পাইলসের অপারেশন হয়েছে। তবে এর পরপরই তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। চিকিৎসকরা বলেছেন, বাবাকে আইসিইউতে রাখতে হবে। ৮ তারিখে ঢাকা মেডিকেল ও বিএসএমএমইউতে জানিয়ে রেখেছি। এখনো সিরিয়াল পাইনি।
বেড নেই হাসপাতালে
ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি হওয়ার মতো কোনো বেড খালি নেই। সরকারি হাসপাতালের করোনা ইউনিটের মধ্যে ২৮০০ বেডের মধ্যে মাত্র ৩০০টি বেড খালি রয়েছে। তবে সেগুলো বিশেষায়িত রোগীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে।
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রি. জে. নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা আক্রান্তদের জন্য ঢাকা মেডিকেলের নতুন ও পুরাতন বার্ন ইউনিট ভবনে মোট ৮০০টি বেড রয়েছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র-আইসিইউ আছে ২০টি এবং হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট-এইচডিইউ আছে ৪০টি। আইসিইউ এবং এইচডিইউতে কোনো সিট খালি নেই। করোনা ইউনিটে গাইনি এবং সার্জারি বিভাগে কিছু সিট খালি আছে, তবে সেগুলোতে অন্য করোনা রোগী ভর্তি করা হয় না। কারণ হঠাৎ করে গর্ভবতী করোনা রোগী বা সার্জারির রোগী এলে তাদের সেখানে ভর্তি রাখা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, সারাদেশেই আশঙ্কাজনকভাবে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে।
হাসপাতালগুলোতে ইতোমধ্যেই ভিড় জমে গেছে। এ অবস্থায় সামান্য সর্দি-জ্বর আর অন্য সাধারণ রোগ নিয়ে রোগীদের হাসপাতালে এসে ভিড় না করার আহ্বান জানাচ্ছি। এ সময়ে তারা যেন ফোনেই চিকিৎসা সেবা নেন। তিনি আরও বলেন, তবে যারা একেবারেই ইমার্জেন্সি রোগী, তারা আসবেই। তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, বিশেষ করে করোনা রোগীরা, যাদের ভর্তি লাগবে তাদের আসতেই হবে। তাদের ঘরে বসে থাকা যাবে না। সার্বক্ষণিক টেলিমেডিসিন সেবা চালু থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্য বাতায়ন চালু আছে। সব হাসপাতালেই টেলিমেডিসিন সেবা চালু আছে। এ সময়ে ইমার্জেন্সি না হলে হাসপাতালে না আসাই ভালো।’
দেশের করোনা পরিস্থিতি
সবশেষ গত ১১ এপ্রিল দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি একদিনে মৃত্যুর নতুন রেকর্ড। একই সময়ে দেশে নতুন করে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৮১৯ জন। এর আগে শনিবার সর্বোচ্চ ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
সবমিলিয়ে দেশে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৬ জনে। মোট মৃত্যু হয়েছে ৯ হাজার ৭৩৯ জনের।
রোববার (১১ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনামুক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ২১২ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯০ জন।
এ সময়ে ২৯ হাজার ২৯৮ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পরীক্ষা করা হয়েছে ২৯ হাজার ৩৭৬টি। মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৫০ লাখ ২ হাজার ৮৬৫টি। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। মোট পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
এআর/এসএম/জেএস