২৮ অক্টোবরের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে অবরোধের নিরাপত্তা পরিকল্পনা
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছ থেকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অনুমতি নিলেও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা। শনিবারের (২৮ অক্টোবর) ওই সহিংসতায় এক পুলিশ সদস্য নিহত হন এবং ৪১ পুলিশ সদস্য আহত হন। এ অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে বিএনপির ডাকা ৩ দিনের অবরোধের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ডিএমপি।
ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, ২৮ অক্টোবরের সহিংসতাকে মাথায় রেখে অবরোধের নিরাপত্তা বলয় সাজানো হচ্ছে। কোনোভাবেই ২৮ অক্টোবরের মতো আরও একটি সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি ঢাকায় হতে দেবে না পুলিশ। এছাড়া অবরোধের শুরু থেকে পুলিশ থাকবে হার্ড লাইনে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো ধরনের অবনতি দেখা দিলেই অ্যাকশনে যাবে পুলিশ। এছাড়া বিএনপির ডাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকবে ঢাকায়।
আরও জানা গেছে, আগামীকালের অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে রাজধানীতে নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করেছে ডিএমপি। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর প্রবেশদ্বারগুলোতে চলছে তল্লাশি। বিশেষ করে প্রবেশমুখ গাবতলী ও গাজীপুর এলাকায় পোশাকে ও সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা যাত্রীদের তল্লাশি করছেন।
এছাড়া ২৮ অক্টোবরের মতো কোনো সহিংসতার পরিকল্পনা বিএনপির আছে কি না সেই তথ্য আগাম জানতে গোয়েন্দা নজরদারিও বৃদ্ধি করেছে ডিএমপি।
অবরোধের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ২৮ অক্টোবরে পুলিশ হত্যাসহ অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলোকে সামনে রেখেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে। বিশেষ করে পুলিশ হত্যার পর অ্যাকশান মুডে আছে ডিএমপি। বিএনপির যে সব নেতাকর্মী ২৮ অক্টোবরের সহিংস ঘটনার জন্য দায়ী এবং অবরোধের সময় যারা নাশকতা করেছে- তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। যদি বিএনপি ২৮ অক্টোবরের মতো আরও একটি সহিংস আন্দোলন করতে চাই তাহলে তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না ডিএমপি।
আরও একটি ২৮ অক্টোবর হতে দেবে না ডিএমপি
বিএনপির ডাকা তিনদিনের অবরোধকে কেন্দ্র করে যত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার তা ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা করে ফেলেছে ডিএমপি।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর প্রতিটি থানার পুলিশ সদস্যদের কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন কোনোভাবেই সহিংস কোনো ঘটনা না ঘটে। এছাড়া প্রতিটি থানার পুলিশকে সতর্ক করা হয়েছে তারা যেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে আগামীকালের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখে। এছাড়া পুলিশ সদস্যদের একা মুভমেন্ট না করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি টহল টিমে পর্যাপ্ত লোকবল নিয়ে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ মহিদ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেব। আর দুষ্কৃতকারীরা আবারও যেন কিছু না করতে পারে সেই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আগের রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু গত ২৮ তারিখে একটি সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি হয়েছে। কাজে সে বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে এবং সেভাবেই আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করছি।
এদিকে ২৮ অক্টোবরের সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির পরবর্তী সময়ে ব্যাপক গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনা করছে ডিএমপি। এছাড়া বিএনপির অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যেসব নেতাকর্মীরা সহিংসতা করতে পারে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদেরও আটক করা হচ্ছে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৩৬ মামলা, তিনদিনে গ্রেপ্তার ১২৯২
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শনিবারের (২৮ অক্টোবর) সহিংসতার ঘটনায় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা রুজু হয়েছে। ডিএমপির বিভিন্ন থানায় এসব মামলা হয়েছে। এসব মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ১ হাজার ৫৪৪ জন। এছাড়া সারা দেশে মোট ১ হাজার ২৯২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ডিএমপি আরও জানায়, সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত ৯ দিনে ঢাকা থেকে মোট ১ হাজার ৭৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২১ অক্টোবর ৩১ জন, ২২ অক্টোবর ৪২ জন, ২৩ অক্টোবর ৪২ জন, ২৪ তারিখ ৮৫ জন, ২৫ তারিখ ১১১ জন, ২৬ তারিখ ২০২ জন, ২৭ তারিখ ৩৪০ জন, ২৮ তারিখ ৬৯৬ জন এবং ২৯ তারিখ ২৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, শনিবার (২৮ অক্টোবর) বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী ঢাকায় সমাবেশ করে। দুপুরের পর কাকরাইল এলাকায় বিএনপির সমাবেশে আসা লোকজনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমাবেশগামী লোকজনের সংঘর্ষ হয়। এসময় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটে। ছবি তুলতে যাওয়া অনেক সাংবাদিককে তখন মারধর করা হয়। একদল যুবক কাকরাইলের আইডিইবি ভবনে ঢুকে কয়েকটি মাইক্রোবাসে আগুন লাগিয়ে দেয়।
এরপর পুলিশ বড় ধরনের অ্যাকশনে যায়। সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল ছুড়ে তারা বিএনপি নেতাকর্মীদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া শুরু করে। এক পর্যায়ে ধাওয়া দিয়ে তারা নয়াপল্টনের মহাসমাবেশও পণ্ড করে দেয়। ধাওয়া খেয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েন। পরে নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন মোড় ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-পুলিশ-আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ হয়।
এসব ঘটনায় বিএনপির বহু নেতাকর্মীর পাশাপাশি অনেক পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকরা আহত হন। নয়াপল্টন এলাকায় এক পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। একইসময় আরও এক পুলিশ সদস্যকে লাঠি দিয়ে গণপিটিুনি দেওয়া হয়। মাথায় হেলমেট থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
এসব ঘটনা চলাকালে এবং পরে সন্ধ্যা ও রাত পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ৫টি বাসে আগুন দেওয়া হয়। রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে হামলা চালিয়ে কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসময় পুলিশ হাসপাতালের সামনে এক ব্যক্তি নিহত হন। বিএনপি দাবি করেছে তিনি তাদের কর্মী।
ঢাকার এসব ঘটনার আঁচ লাগে জেলা পর্যায়েও। রাতে সাভার, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
রোববার সকাল-সন্ধ্যা এ হরতাল পালনের পর সোমবার বাদ দিয়ে মঙ্গলবার থেকে পুনরায় টানা তিনদিনের অবরোধ কর্মসূচি দেয় বিএনপি।
এমএসি/এমজে