মধ্যপ্রাচ্য সংকট দীর্ঘ হলে বিশ্বে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা
হামাস-ইসরায়েল সংঘাত কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। এতে করে বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক ধরনের মেরুকরণ হয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায় যদি এখনই গাজায় সংঘাত বন্ধে উদ্যোগী না হয় তাহলে চলমান সংঘাত আরও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর মধ্যপ্রাচ্যে এ সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে সারাবিশ্বে এর প্রভাব পড়বে। যে তালিকা থেকে বাদ যাবে না বাংলাদেশও।
ঢাকার একাধিক কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাজাসহ ফিলিস্তিনের অন্যান্য স্থানে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর সাম্প্রতিক বর্বরোচিত হামলার নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। ইসরায়েলের সঙ্গেও নেই কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক। তবুও বাংলাদেশ উভয়পক্ষকে জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা এবং সংলাপের মাধ্যমে সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। সৌদি আরবে ওআইসির জরুরি বৈঠকেও বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।
ঢাকার এক কূটনীতিক বলেন, কোভিড মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এখন বিশ্ব ভুগছে। এরপরে মধ্যপ্রাচ্য সংকট শুরু। হামাস-ইসরায়েলের চলমান সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে এটা কারও জন্য সুখকর হবে না। এর প্রভাব সবাইকে ভোগ করতে হবে। বিশেষ করে বৈশ্বিক বাণিজ্যিক সংকট দেখা দিতে পারে। তেল-ডলারসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
এ কূটনীতিক বলেন, আশার কথা হলো— ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ দেখা যাচ্ছে। যেটা এর আগে অনেক ঘটনায় দেখা যায়নি। তবে দেখার বিষয় শেষ অবদি এ সংকট সমাধানে তারা এক থাকতে পারে কি না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক পরাশক্তি কিন্তু ইসরায়েলের হয়ে কথা বলছে। তারা হামাসকে নির্মূলের কথা বললেও গাজার সাধারণ মানুষের যেন ক্ষয়ক্ষতি না হয়— সেই বার্তাও দিচ্ছেন। আবার রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক ও সৌদি আরবও তাদের নিজ নিজ অবস্থানের কথা জানান দিচ্ছে। এরই মধ্যে বৈশ্বিক রাজনীতিতে কিন্তু এক ধরনের মেরুকরণ তৈরি হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন
গাজার পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে মধ্যপ্রাচ্যের এ সংকট কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন এ কর্মকর্তা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সহসায় শুরু হওয়া হামাস-ইসরায়েল সংঘাত এক জায়গায় স্থির থাকার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি আরও প্রকট হলে মধ্যপ্রাচ্যের এ সংকট কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে যেতে পারে।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, এ সংঘাত একেবারে থেমে যাবে বা আগের অবস্থায় ফিরে যাবে বলে আমি মনে করি না। তবে এখনই এ সংঘাত বন্ধ না করা গেলে অর্থাৎ এটি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে সারাবিশ্বে এর প্রভাব পড়বে। সেই আঁচ থেকে বাংলাদেশ বাদ যাবে— তা বলার কোনো সুযোগ নাই। বিশ্বের কোনো প্রান্তে খারাপ কিছু ঘটলে তার প্রথম ধাক্কাটা লাগে কিন্তু তেলের বাজারে। ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে বেড়ে গেছে। তেলের দাম বাড়ার প্রভাব কিন্তু কৃষিপণ্যের ওপরও পড়ে। তখন অন্যান্য সংকটগুলো সামনে আসে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিমউদ্দিন খান বলেন, ইসরায়েল গাজায় হাসপাতালে যে আক্রমণ চালিয়েছে তা গণহত্যা ছাড়া অন্য কিছু না। এ ঘটনার পর ফিলিস্তিন ইস্যুটা এখন মানবিক আবেদন থেকে অনেক শক্তিশালী হয়েছে। যার ফলে বিশ্ব জনমত পুরোটাই মনে হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আছে। এটা ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। তবে দিন শেষে মুসলিম দেশগুলোর এই পরিবর্তন কতটা কার্যকরী হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কেননা মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে কোনো ঐক্য নেই।
আরও পড়ুন
মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক তানজিম বলেন, এ সংকটের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব শক্তিশালী করতে রাশিয়া এবং চীনের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন খুব জটিল। এ অবস্থা যদি সামলানো না যায় তবে মধ্যপ্রাচ্যের এ সংকট আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে যাবে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে— হিজবুল্লাহসহ অন্যরা যদি এ যুদ্ধে যুক্ত হয় তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হয়ে যাবে। তখন সেটা ফিলিস্তিন বা ইসরায়েল ইস্যু থেকে অন্যদিকে মোড় নেবে। আর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়বে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে।
ধারণা করা হচ্ছে, হামাস-ইসরায়েল সংঘাতকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি জটিল হলে অভিবাসন খাতে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য এক ধরনের সংকট তৈরি হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মনে হয় না এ সংকট অভিবাসন পর্যন্ত গিয়ে পড়বে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না করা গেলে হয়ত ভবিষ্যতে এর খারাপ প্রভাব পড়বে। সেটা না হওয়ায় আমাদের জন্য ভালো। কারণ আমাদের বিশাল অভিবাসী কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মী থাকে সৌদি আরবে।
তিনি আরও বলেন, কোভিড মহামারির কারণে ইতোমধ্যে আমাদের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেক কর্মী দেশে ফিরে এসেছে। সে সময়ের অনেকেই আর বিদেশ যেতে পারেনি। শ্রমবাজার বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য মধ্যপ্রাচ্য খুবই গুরত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের সংকট যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে আমাদের শ্রমবাজারে এর প্রভাব কিছুটা হলেও পড়বে। আশা করছি গাজার সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে। গাজার সাধারণ মানুষের কথা ভেবে হলেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবেন।
প্রসঙ্গত, গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এদিন হঠাৎ ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ঢুকে হামলা শুরু করে হামাস সদস্যরা। ওইদিন থেকে গাজা উপত্যকা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালাতে থাকে ইসরায়েল। এ হামলার প্রতিবাদে লেবানন থেকে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে মাঝে মধ্যে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে হামাস ও হিজবুল্লাহ। চলমান এ সংঘাতে ইতোমধ্যে প্রাণ হারাচ্ছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, চলমান উত্তেজনার ১৩তম দিন(শুক্রবার) পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় ৪ হাজার ১৩৭ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে শিশুই হলো ১ হাজার ৬৬১ জন। এছাড়া আহত হয়েছেন ১৩ হাজার ২৬০ জন ফিলিস্তিনি। অন্যদিকে হামাসের হামলায় কমপক্ষে দেড় হাজার ইসরায়েলি নিহত হন।
এনআই/এমজে