চোখের জলে কি আগুন নেভে?
‘আগুন লাগার পরপরই খবর পাইছি। রাতেই ছুটে আসি এখানে। নিজের জুয়েলারি দোকানের সামনে আইসা দেখি পাশের দোকান জ্বলছে। ভাবছিলাম দোকানের স্বর্ণালংকার বের করতে পারব। কিন্তু শাটার খুলে ভেতরে ঢোকার অবস্থা ছিল না। উপরে সব জ্বলছিল। জীবন বাঁচাব নাকি দোকান? চোখের সামনে সব পুড়ছিল। পানির জন্য হাহাকার মার্কেটজুড়ে। সবার চোখে তখন পানি— কিন্তু চোখের জ্বলে কি আর আগুন নেভে?’
মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের আগুনে নিঃস্ব হয়ে পড়ার কথা বলছিলেন স্বর্ণ দোকানি বিল্লাল হোসেন।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৪টার দিকে মার্কেটের ডানদিকে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করলেও পরে একে একে ১৭টি ইউনিট যুক্ত হয়। প্রায় সোয়া ৫ ঘণ্টা পর সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণের কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস।
ব্যবসায়ীরা জানান, কৃষি মার্কেটের নতুন কাঁচা বাজারে লাগা আগুনে অন্তত ১৮টি স্বর্ণের দোকান পুড়ে গেছে। এর মধ্যে মার্কেটের সামনের অংশে ৯টি ও ভেতরে ৯টি দোকান ছিল। আলিফ জুয়েলার্স, হেনা জুয়েলার্স, দুবাই জুয়েলার্স, সিঙ্গাপুর জুয়েলার্স, মুন জুয়েলার্স, রিয়াদ জুয়েলার্স, মা জুয়েলার্সের মতো মার্কেটের সামনে থাকা শুভেচ্ছা জুয়েলার্সও হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি জুতা কাপড় স্বর্ণসহ ব্যবহার্য বহু পণ্য পাওয়া যেত।
ক্ষতিগ্রস্ত জুয়েলার্স ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘১৯৯০ সাল থেকে যৌথ মালিকানায় শুরু শুভেচ্ছা জুয়েলার্সের। মার্কেটের পশ্চিম-উত্তর পাশ থেকে ৮ মাস আগে স্থানান্তর করা হয় উত্তর-পূর্ব বর্ধিত অংশে। রাতে আগুন লাগবে ভাবিনি। এভাবে চোখের সামনে কোটি টাকার সম্পদ পুড়ছে, চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করতে না পারছি না।’
পাশেই কোটি টাকার সম্পদের দুটি পাশাপাশি কসমেটিকসের দোকান পুড়ে গেছে আগুনে। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সহোদর জহিরুল ইসলাম লিটন আর জসিম উদ্দিনের হাহাকার আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ।
গলাগলি করে দুই সহোদর কান্নজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘কসমেটিকস জোন ও ভাই ভাই কসমেটিকস নামে পাশাপাশি দুটি দোকান আমাদের। চোখের সামনে কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে কিচ্ছু করতে পারলাম না। একটা কিচ্ছু বের করতে পারিনি। একটা সুতাও না, এখন কী করব, কোথায় যাব কার কাছে যাব?’
জসিম বলেন, ‘আগুন লেগেছে মার্কেটের ওই মাথায় (পূর্ব পাশে)। সেই আগুন পুড়তে পুড়তে এই মাথায় (পশ্চিম) আসতেও তো সময় লাগে। ততক্ষণেও যদি ফায়ার সার্ভিস আসত তাহলে অনেকেই বেঁচে যেতাম। দেখেন কিচ্ছু নেই- মাল গেছে, দোকান গেছে, সব গেছে। আমরা এখন কী করে খাব?’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার ৮/৯ লাখ টাকার মাল ছিল দোকানে। গতকালও আমি ৮০ হাজার টাকার মাল ঢুকাইছি। একটা মালও আমি বাঁচাতে পারিনি। পানির কারণে আমরা মার্কেটটা বাঁচাতে পারলাম না। এতবার ফোন দিছি, দোকান বাঁচাতে পারিনি।’
রাত ৩টার আগে আগুন লেগেছে দাবি করে ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে শামসুল হক বস্ত্রালয়ের কর্মী আল-আমিন বলেন, ‘মার্কেট রাত ১০টায় বন্ধ হয়ে যায়। বাসায় গিয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ৩টার দিকে খবর পাই আগুন লেগেছে মার্কেটে। তার মানে আগুন আরও আগে লাগে। এক দৌড়ে চলে আসি এখানে। তখনও মার্কেটে পুরোপুরি আগুন ছড়িয়ে পড়েনি। দোকান খুলে ভেতরে প্রবেশ করছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। গরমে আর আগুনের তাপে বের হতে বাধ্য হই। এরপর তো আগুন আর আগুন। কিছুই বাকি নেই, সব পুড়ে গেছে।’
রাতে মার্কেটে বিদ্যুৎ সঞ্চালন বন্ধ থাকে
মা বস্ত্রালয়ের সাইদুর ইসলাম বলেন, ‘বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন রাত ১০টায় বন্ধ হয়ে যায়। আগুন লাগল প্রথম উত্তরপূর্ব পাশে। ফায়ার সার্ভিস আসে দেড় ঘণ্টা পর। কীভাবে যেন আগুন পুরো মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে আগুন ওখানে আগুন। আন্দাজ করতে পারছি না কীভাবে আগুনের সূত্রপাত।’
ফায়ার সার্ভিস আসে দেড় ঘণ্টা পর, পানি ছাড়া
আমির হামজা ও জালাল বস্ত্র বিতানের মালিক মো. ফজলুল হক বলেন, ‘লাখ দেড়েক টাকা ছিল। ঋণ না থাকলেও বাকিতে আনা মাল ছিল দোকানে। গতকালও ২০ হাজার টাকা জমা দিয়ে বাকিতে ৪ লাখ টাকার মাল এনেছি। চার লাখের চার পয়সাও বিক্রি করতে পারিনি। সব পুড়ে গেল।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘মার্কেট যখন পুড়ছিল তখন ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসে মাত্র দুটি। আগুন বাড়তে থাকে। ফায়ার কর্মীরা পাইপ ধরে টানাটানি করে। পুড়ে যখন প্রায় শেষ তখন ফায়ারের বাকি সব গাড়ি আসে। প্রথমে তারা ভেতরেই ঢোকেনি। আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর তারা বলছে ফায়ার সেফটি ছিল না। আমাদের সব পুড়ে গেল। ফায়ার সার্ভিস যদি আগে আসত, পানি দিত, হয়ত অনেক দোকান বেঁচে যেত।’
দোকানের উপরেই সংসার আলমগীরের
মায়ের দোআ বস্ত্র বিতানের আয়ে চলে আলমগীরের সংসার। আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া দোকানের সামনে ঠায় বসে আছেন তিনি। কী করবেন ভেবে কোনো কূল কিনারা পাচ্ছিলেন না।
তিনি বলেন, ‘একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। সামনে কী করব জানি না। আবার দোকান কী করে সাজাব? যত্নে গড়া দোকানটা চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো!’
আরেক বৃদ্ধ ব্যবসায়ী বলেন, রাত সাড়ে ৩টার দিকে আগুনের কথা জানতে পেরে ছুটে আসেন তিনি। কাপড়ের দোকান তার। ৩টা দোকানেরই সব মাল পুড়ে গেছে।
আগুনের পেছনে ‘নাশকতা’র সন্দেহ ব্যবসায়ীদের
ব্যবসায়ী জহিরুল বলেন, ‘সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন বেশি থাকে কৃষি মার্কেটে। রাত ১০টার পর বিদ্যুৎ সঞ্চালন বন্ধ করে দেওয়া হয়। যখন লোড বেশি থাকে তখন শর্ট-সার্কিট হলো না, তখন আগুন লাগল না। যখন বিদ্যুতের লাইন বন্ধ তখন কীভাবে আগুন লাগল? রাত ১০টার পর শর্ট-সার্কিট হবে কীভাবে? এই আগুনে চক্রান্ত আছে।’
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা পজিশন হারানোর নতুন আতঙ্কে
আগুনে নিঃস্ব হওয়া ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে আছেন। এখন পজিশন হারানোর আতঙ্ক তাদের। মার্কেট নতুন করে গড়া হলে বা বহুতল ভবন করা হলে তাদের যে পজিশন ছিল সেটি হারাতে পারেন তারা।
এ ব্যাপারে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমার তো সব গেছে, কিন্তু পজিশনও যদি যায় তাহলে আমি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারব না। আমি কই যাব তাহলে। আমার দাবি, ক্ষতিপূরণ দেন, সেটা যদি পুষিয়ে নাও দেন অন্তত দোকানের পজিশনটা দিয়েন, যাতে আমি আবার দাঁড়াতে পারি। এমন দাবি অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর।’
ফায়ার সেফটি ছিল না কৃষি মার্কেটে : ফায়ার সার্ভিস
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষি মার্কেটে কোনো ফায়ার সেফটি ছিল না। প্রাথমিক ফায়ার ফাইটিংয়ের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। ফুটপাত ও সড়কে দোকান থাকায় এবং উৎসুক মানুষের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়েছে। পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও ছিল না। তাদের বারবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে গণসংযোগ করা হয়েছে। সচেতনতার প্রোগ্রাম যেভাবে আমরা করেছি সেভাবে তারা সাড়া দেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘এই মার্কেটটা কিছুটা বঙ্গবাজার টাইপের। এখানে ভেতরে অনেক সাবওয়ে ছিল ছোট ছোট। ভেতরের যত রাস্তা এবং বাইরের ছোট ছোট রাস্তা সবগুলোতেই মালামাল রাখা ছিল এবং গাদাগাদি করে রাস্তাটা বন্ধ করা ছিল। পুরো মার্কেটটাই গেট দিয়ে আটকানো ছিল।’
তিনি দাবি করেন, ‘আগুন ধরার খবর পেয়ে ৯ মিনিটের মাথায় আমরা এখানে চলে আসি। রাত ৩টা ৫২ মিনিট থেকে আমরা এখানে আগুন নির্বাপণের কাজ শুরু করি।’
আর থামবে না ডিএনসিসি, মার্কেট সিলগালা হবে : সেলিম রেজা
পরিদর্শন শেষে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘ডিএনসিসির পক্ষ থেকে আগে কৃষি মার্কেটে ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা পরিদর্শন করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা ফায়ার সেফটি পাইনি। আগুন লাগলে নেভানোর ব্যবস্থা যেন থাকে সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আগেই বলা হয়েছিল। কিন্তু মার্কেট কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। উত্তরে ৮টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। ভবন ও যেই মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে সেগুলোর বিরুদ্ধে ১৫ দিন বা ১ মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে আমরা ম্যাজিস্ট্রেটকে বলে দিয়েছি। কোনো বাধা, কোনো কিছুর মুখেই আমরা আর থামব না। এই ভবনগুলোতে ব্যবসায়ী এবং বসবাসকারী যারাই থাকুন তাদের সেখান থেকে বের করে দিয়ে ভবনগুলোকে সিলগালা করে দিতে হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই ভবনগুলোকে ফাঁকা করতে হবে।’
‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হওয়ার নোটিশ পাননি ব্যবসায়ীরা
ঢাকা মহানগর দোকান ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি আরিফুর রহমান টিপু বলেন, কৃষি মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ, এমন কোনো নোটিশ ব্যবসায়ীরা পাননি। অগ্নিকাণ্ডে মার্কেটের ৪০০ দোকানের মধ্যে তিন শতাধিক দোকান পুড়ে গেছে। এতে ব্যবসায়ীদের ৩০০-৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
দোকান ব্যবসায়ী মালিক সমিতির যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান মাহমুদ বলেন, ‘এই মার্কেট যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয় তাহলে আগে বন্ধ করা হলো না কেন? আগুন লাগলে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পায় দোকান মালিক! কেন? আগুন লাগলে ক্ষতি তো হয় দোকান ব্যবসায়ীর।’
তালিকা করে মানবিক সহায়তা : ডিসি ঢাকা
ঢাকার জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের একটি তালিকা করব। তারপর আমরা সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করব।’
জেইউ/এসকেডি