মায়ের অ্যাকাউন্টে শুরু, এমটিএফইর লাভ দেখে লোভে পড়ে পুরো পরিবার
মায়ের বান্ধবীর স্বামীর সঙ্গে পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে প্রথমে এমটিএফইর কথা জানতে পারেন মারুফ রহমান মাহিম নামে এক যুবক। তিন মাসে দ্বিগুণ লাভের গল্প শুনে লোভে পড়ে প্রথমে মায়ের কাগজপত্রে এমটিএফইতে অ্যাকাউন্ট খোলে মাহিম। এজন্য মায়ের বান্ধবীর স্বামীর হাতে তুলে দেয় ২৮ হাজার টাকা। পরদিনই অ্যাপস ইন্সটল করে ওয়ালেটে দেখতে পান ২০৫ ভার্চুয়াল ডলার। এতে আরও আগ্রহ বেড়ে যায় মাহিমের।
এরপর প্রতিদিন (শুক্র ও শনিবার বাদে) ভার্চুয়াল ওয়ালেটে যুক্ত হতে থাকে ৫ ডলার। এভাবে ৪৫৬ ডলার পর্যন্ত যুক্ত হয়। অল্প পুঁজিতে এত টাকা আয় দেখে উৎফুল্ল চিত্তে নিজেসহ বাবা, ভাই, বন্ধুসহ আরও অনেকের অ্যাকাউন্ট খোলেন। আর এমটিএফইতে লগ্নি করা হয় লাখ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন : ডেসটিনির মতো শুয়ে-বসে আয়ের লোভ দেখিয়ে উধাও এমটিএফই
হঠাৎ করে একদিন ওয়ালেটের ডলার উত্তোলনে নিষেধ করেন মায়ের বান্ধবীর স্বামী। এর বিপরীতে ৫ হাজার করে টাকা দেন তিনি। কিন্তু গত ১৬ আগস্ট মাহিম হঠাৎ করে ওয়ালেটে ঢুকে দেখেন- ব্যালেন্স জিরো দেখাচ্ছে। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ার দশা মাহিমের।
এমন অবস্থা শুধু মাহিমের নয়, আরও অনেকেরই। পরবর্তীতে খোঁজ-খবর নিয়ে বুঝতে পারেন পুরো বিষয়টা স্ক্যাম ছিল। মায়ের বান্ধবীর স্বামীও ছিলেন প্রতারক। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন দুবাইয়ে।
এমটিএফইতে লগ্নি করে প্রায় স্বপরিবারে প্রতারিত হওয়া ওই যুবক ইতোমধ্যে থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
গত সোমবার(২৮ আগস্ট) রাতে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় দায়ের করা ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে- এমটিএফইর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মো. মাসুদ আল ইসলাম(৪৫), অ্যাম্বাসেডর মুবাশসিরুল ইবাদ(৪২) ও অনলাইন এমএলএম কোম্পানি মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জসহ (এমটিএফই) অজ্ঞাতনামা ৫০/৬০ জনকে। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ(সিআইডি)।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, বাদী মাহিম খিলগাঁও মডেল কলেজের ছাত্র। তার সঙ্গে পূর্ব থেকেই পরিচয় ছিল মামলার দুই নং আসামি মুবাশসিরুল ইবাদের। কারণ, তিনি মায়ের বান্ধবীর স্বামী। রাজধানীর বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় ও পূর্ব পরিচিতি থাকায় তাকে আঙ্কেল ডাকতেন মাহিম।
আরও পড়ুন : এমটিএফই অ্যাপে কোটিপতি নুরুন্নবী, নতুন ফাঁদ জিটিসি-এক্স
৬ মাস আগে মুবাশসিরুল ইবাদ সর্বপ্রথম এমটিএফই অ্যাপসের কথা মাহিমকে বলেন। তিনি জানান, এই প্লাটফর্মে ২০১ ডলার ইনভেস্ট করলে প্রতিদিন (সপ্তাহে ৫ দিন) সেখান থেকে লাভ হবে পাঁচ ডলার করে। এছাড়া অন্য কাউকে এই প্লাটফর্মে প্রবেশ করাতে পারলে ও ইনভেস্ট করলে ১২ শতাংশ কমিশন দেওয়া হবে। যদি তার মাধ্যমে অন্য কেউ ইনভেস্ট করে তাহলে সেখান থেকেও ৮ শতাংশ কমিশন পাওয়ার প্রলোভনও দেখানো হয়।
মাহিমের দাবি, প্রথমে মুবাশসিরুল ইবাদ আঙ্কেলের কথা বিশ্বাস করিনি। তাছাড়া আমার ইনভেস্ট করার মতো টাকাও ছিল না। পরবর্তীতে বিভিন্ন রকম প্রলোভন দেখাতে থাকে এবং জানায় অনেকেই এই অ্যাপসে ইনভেস্ট করে লাভবান হচ্ছে।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুবাশসিরুল ইবাদ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত সদস্য। পূর্ব পরিচিত হওয়ায় আশ্বস্ত হয়ে মাহিম প্রথমে ২৫ জুন এমটিএফই অ্যাপস ইন্সটল করে মায়ের নামে একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। গত কুরবানির ঈদের পর মুবাশসিরুল ইবাদ দক্ষিণ বনশ্রীতে এসে মাহিমের কাছ থেকে জমানো ২৮ হাজার টাকা নিয়ে যান। টাকা দেওয়ার আধাঘণ্টা পরে এমটিএফই অ্যাকাউন্টে দেখা যায় ২০৫ ভার্চুয়াল ডলার। পরবর্তীতে ট্রেড করার অপশন চালু করলে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই অ্যাপসে ট্রেড হতো এবং লাভের টাকা প্রতিদিন ৫ ডলার করে (ভার্চুয়াল ডলার) অ্যাকাউন্টে জমা হতে থাকে। হঠাৎ করেই ১৬ আগস্ট অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স জিরো হয়ে যায়।
এরপর তারা জানতে পারে- গত ১৪ আগস্ট দুবাই চলে গেছেন মুবাশসিরুল ইবাদ। পুরো বিষয়টা একটা স্ক্যাম ছিল।
শুধু মাহিম নন একই প্রক্রিয়ায় মাহিমের বাবার কাছ থেকে ৫০ হাজার, তার ভাই আবু নাছেরের কাছ থেকে তিন লাখ, এলাকার বড় ভাই ইমনের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় অভিযুক্ত মুবাশসিরুল। এছাড়া ইজদিন ও তাকমিরে নামক আরও দুইজন কয়েক শ’ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
আরও পড়ুন- ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে তথ্য সহযোগিতা চায় সিআইডি
এদিকে মামলার তথ্য বলছে, শুধু মাহিম নয় এভাবে প্রায় কয়েক হাজার মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে মুবাশসিরুল ইবাদ। পরবর্তীতে তিনি দুবাই থাকা অপর সহযোগী মাসুদ আল ইসলামের কাছে গিয়ে আত্মগোপন করেন।
আরেক ভুক্তভোগী মাহিমের বড় ভাই আবু নাছের ঢাকা পোস্টকে বলেন, লগ্নি করার আগে বুঝতে পারিনি ওরা এতো বড় বাটপারি করবে। কমিশনের লোভ দেখিয়ে আর মিস্টি কথায় ভুলিয়ে শুধু আমাদের নয়, রামপুরা বনশ্রী এলাকার অন্তত সাড়ে ৩০০ মানুষের সঙ্গেই এ প্রতারণা করা হয়েছে। পরে নিউজ দেখে জানতে পারি- শুধু আমাদেরই নয়, সারাদেশ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে চক্রটি।
অনেক ভুক্তভোগীই এখন মামলা করতে আগ্রহী উল্লেখ করে তিনি জানান, আমার সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করছেন। কয়েকদিনের মধ্যে আরও কয়েকটি মামলা হবে।
এ বিষয়ে খিলগাঁও থানার ওসি মনির হোসেন মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে এমটিএফই নামে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসার মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে ডিজিটাল প্রতারণা করা হয়েছে। এই অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি।
মামলা সম্পর্কে সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন পর্যন্ত শতাধিক ভুক্তভোগী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই মামলা বা লিখিত অভিযোগ করতে চান না। অনেক বোঝানোর পর একজন ভুক্তভোগী খিলগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলায় এমটিএফই প্রতারণা সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। মামলাটি আমরা তদন্ত করছি।
জেইউ/এমজে