বিদ্যুৎ ব্যবহারে মাসিক খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ
একটি ওষুধ কোম্পানিতে রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি পেয়ে বছরের শুরুতে ঢাকায় এসেছেন শেখ মেহেদী হাসান। দুই রুমের বাসায় একাই থাকে। শুরুর কয়েকমাস বিদ্যুৎ বিল নিয়ে কোনো অসস্তি না থাকলেও জুন-জুলাই মাসের বিল দেখে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। আগের তুলনায় এখন তার বিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচ ৩০-৩৫ শতাংশ বেশি আসছে। সীমিত আয়ের চাকরিতে প্রতিমাসে এরকম বাড়তি খরচ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে শেখ মেহেদী হাসানের মতো অবস্থা বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের। বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রভাব পড়ছে অন্যান্য নিত্যপণ্যে। ফলে খরচও বাড়ছে হু হু করে।
২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত চার দফায় বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। কিন্তু এর প্রভাবে অন্যান্য খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সব ধরনের বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার। ওই সময় পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ ও খুচরা পর্যায়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। এরপর ৩ বছরের মাথায় নির্বাহী আদেশে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি, ৩১ জানুয়ারি ও ২৮ ফেব্রুয়ারি তিন দফায় মোট ১৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। এই ২০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিতে সর্বনিম্ন ইউনিটপ্রতি মোট বিদ্যুতের দাম বাড়ে ৮০ পয়সা।
সর্বশেষ বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রভাব মূল্যায়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) জানিয়েছিল, লাইফ লাইন গ্রাহকের (আবাসিক) ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ব্যয় বাড়বে মাসে ৫ টাক থেকে সাড়ে ১৭ টাকা পর্যন্ত। নিম্ন মধ্যবিত্ত গ্রাহকের (আবাসিক) গড়ে মাসে বিল বৃদ্ধি পাবে ৪৪ টাকা (প্রায় ৫ দশমিক ৯ শতাংশ), মধ্যবিত্ত গ্রাহক (আবাসিক) বিল বৃদ্ধি পাবে গড়ে ১১৪ টাকা (প্রায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশ)।
কতটুকু বাড়ল গ্রাহকের চাপ?
২০২০ সালের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য দাঁড়িয়েছিল ৩ টাকা ৭৫ পয়সায়। অর্থাৎ সর্বনিম্ন ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে গ্রাহকের অন্যান্য খরচ বাদে বিদ্যুৎ বিল আসতো ১৮৭ টাকা। ৫০ ইউনিটের বেশি খরচ করলে সে ট্যারিফ মোতাবেক বিল আসতো।
২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত তিন দফায় ১৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির পর ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হয়েছে ৪ টাকা ৩৫ পয়সায়। অর্থাৎ ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে গ্রাহকের অন্যান্য খরচ বাদে বিদ্যুৎ বিল আসবে ২১৭ টাকা। ৫০ ইউনিটের বেশি ব্যবহার করলে সে ট্যারিফ মোতাবেক বিল আসবে।
মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব জানতে কথা বলা হয় মিরপুরে বসবাসকারী হাসান জয়ের সঙ্গে। ডেসকোর আওতাধীন এ গ্রাহক ব্যবহার করেন পোস্টপেইড মিটার। তিনি ঢাকা পোস্টকে ২০২২ সালের মে মাস ও ২০২৩ সালের মে মাসের বিলের তথ্য জানান।
তার দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালের মে মাসে বিলের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮০৪ টাকা। আর ২০২৩ সালের মে মাসে বিলের পরিমাণ ১ হাজার ৯৮০ টাকা। এই এক বছরে তার বাসায় বিদ্যুৎ ব্যবহারে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।
হাসান জয় ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে যে বিলটা আমাদের আসতো, দাম বাড়ানোর পর কিছু টাকা বেশি আসছে। তবে এটা আরও বেশি আসতে পারতো, কারণ দাম বাড়ানোর পর আমরা বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হয়েছি।
আরেক গ্রাহক মোস্তাফা পাটোয়ারী বসবাস করেন গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকায়। পল্লি বিদ্যুতের আওতাধীন এ গ্রাহক পোস্টপেইড মিটার ব্যবহার করে থাকেন।
তার কাছে গত এক বছরের বিদ্যুৎ বিলের পরিসংখ্যান জানতে চাওয়া হয়। তথ্যমতে দেখা যায়, ২০২২ সালে এপ্রিল-মে-জুন মাসে গড়ে বিল আসতো ১ হাজার ২০০ টাকা। ২০২৩ সালে যার পরিমাণ ১ হাজার ৪০০ টাকা।
মোস্তফা পাটোয়ারী বলেন, গত বছরে গরমের সময় যে পরিমাণ বিল আসতো, এ বছর তার চাইতে কিছুটা বেশি এসেছে। তবে আমি চেষ্টা করি যথাসম্ভব সাশ্রয়ীভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের।
চাপ বেড়েছে বাণিজ্যিক খাতেও
আবাসিক গ্রাহকের পাশাপাশি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চাপ পড়েছে বাণিজ্যিক খাতেও। বিইআরসির তথ্যমতে, ক্ষুদ্র শিল্প গ্রাহকদের গড়ে বিদ্যুৎ খরচ বেড়েছে ৮১০ টাকা (৪ দশমিক ৯ শতাংশ), মাঝারি শিল্প গ্রাহকের বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৪০ টাকা (প্রায় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ), বৃহৎ শিল্প গ্রাহকের খরচ বেড়েছে প্রায় ৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা (প্রায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ)।
মূল্যবৃদ্ধির পর বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন বা বিটিএমএ জানিয়েছিল, বিভিন্ন গ্রাহক শ্রেণির খুচরা বিদ্যুতের মূল্যহার প্রতি কিলোওয়াট ৬ দশমিক ৭৭ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৭ দশমিক ১৩ টাকায় নির্ধারণসহ অন্যান্য চার্জ বৃদ্ধি টেক্সটাইল খাতের বিদ্যমান অবস্থানকে বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারিমানের উইভিং মিল এবং বৃহদাকার স্পিনিং মিল যারা গ্রিড পাওয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে মিল পরিচালনা করছে, তাদের বিপর্যস্ত করবে। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিটিএমএ কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি কর্তৃক তাদের উৎপাদিত বিদ্যুতের মান নিয়ে যে প্রশ্ন ও তার সমাধানের জন্য যেসব বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
আপাতত বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ও ফের দাম বাড়তে পারে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবীবুর রহমানের কাছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে জনগণের ওপর কিছুটা চাপ পড়ছে, এটা ঠিক। তবে আমরা বারবারই বলে এসেছি যে, গ্রাহকদের সাশ্রয়ী হতে হবে। তারা সাশ্রয়ী হলেই এই চাপটা অনেকাংশেই কাটিয়ে উঠতে পারবেন।আর আপাতত বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
বিদ্যুৎ বর্তমানে জনজীবনের একটি অন্যতম চালিকাশক্তি। এর মাধ্যমে অর্থনীতির একটি বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়লে জনজীবনে তার প্রভাব সার্বিকভাবেই পড়ে।
এসব বিষয়ে ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে সব কিছুর খরচ বেড়ে গেল। ফলে জনগণ খরচ কমিয়ে দিয়ে ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটতে লাগলো। আগে তারা ভোগ্যপণ্য ও সেবাপণ্যে যে খরচটা করতো, সেটাও কমিয়ে দিল। আর এই বিষয়টি নেতিবাচক, কারণ এতে করে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যায়, যার ফলে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং এতে করে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। সুতরাং সার্বিকভাবেই বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতি ও জনজীবনে একটি নেতিবাচক প্রভাবই রেখেছে।
ওএফএ/এসএম