আগুন-ছাই-কাঁচের টুকরো, হেফাজতের ধ্বংসযজ্ঞে আতঙ্কে নারায়ণগঞ্জ
সোনারগাঁয়ের খাসনগর দিঘীরপাড়ের গোটা এলাকা তখন অন্ধকার। সড়কের দুই পাশে ফেলে রাখা হয়েছে কলাগাছ। সামনে আবার ছোট ছোট আগুনের ধ্বংসাবশেষ। খাসনগর থেকে মুগদাপাড়া এলাকায় যেতে দেখা মিলেছে শুধু আগুন আর কাঁচের টুকরোর। দেখেই মনে হলো ‘মাত্রই যেন যুদ্ধ থামল’।
ছোট ছোট দল করে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এলাকার লোকজন। কেউ আবার ঘরে বসে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছেন সড়কের দিকে। সবার চোখে-মুখেই আতঙ্কের ছাপ। সংবাদকর্মী পরিচয় শুনে একজন বলেই ফেললেন, ‘স্বাধীনতার পর এমন যুদ্ধ এই প্রথম দেখলাম’। শনিবার রাত ১০টায় এমন পরিস্থিতি ছিল দিঘীরপাড়ের।
ঠিক তার কয়েক ঘণ্টা আগেই সোনারগাঁ রয়েল রিসোর্টের ৫০১ নম্বর কক্ষে নারীসহ অবরুদ্ধ হন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। রিসোর্ট থেকে তাকে উদ্ধার করতেই ওই এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায় দলটির নেতাকর্মীরা।
রয়েল রিসোর্টের এক কর্মচারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রাতে যখন মামুনুলসহ পুলিশ সদস্যরা ভেতরে ছিলেন, তখন হেফাজতের কর্মীরা তাকে ছিনিয়ে নিতে গেট ধাক্কা দিচ্ছিল। একপর্যায়ে গেট ভেঙে কয়েকজন ভেতরে এসে মামুনুলকে ছিনিয়ে নিয়ে যান। আরেকদল রিসোর্টের গেট, লবিসহ বেশ কয়েকটি ঘরে ভাঙচুর চালায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘রিসোর্টে কয়েকজন বিদেশি অতিথি ছিলেন। তারাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আন্দোলনের একপর্যায়ে হেফাজত কর্মীরা রয়েল রিসোর্টটি পুড়িয়ে দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছিল। পরে পুলিশ এসে ফাঁকা গুলি ছুড়ে তাদের সরিয়ে দেয়।’
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, পুলিশের ধাওয়া খেয়ে হেফাজতের কর্মীরা মুগদাপাড়ার দিকে চলে যায়। তারা সড়কে গাছ ফেলে সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও অবরোধ করে। এ সময় হেফাজতের নেতারা মামুনুল হককে ‘হয়রানি করা’ ছাত্রলীগ কর্মীদের গ্রেফতার দাবি করেন এবং বেশ কয়েকটি বাস ভাঙচুর করেন।
এর কিছুক্ষণ পরই ঘটনাস্থলে বিজিবি উপস্থিত হয়। তিনটি সাঁজোয়া যানের সাহায্যে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থলের পাশ থেকে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দও শোনা যায়।
রাতে যেমন ছিল রিসোর্টের চিত্র
রিসোর্টের একপাশের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে পুলিশ। ভেতরের যে ভবনে বিদেশি অতিথিরা ছিলেন, সেখানেও নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। রাত ১০টার দিকে পুলিশ মাইকিং করে বলে, ‘বহিরাগত বা হেফাজতের কেউ থাকলে নেমে আসুন। ঘরে ঘরে তল্লাশি করা হবে।’ রাত সাড়ে ১০টার দিকে উৎসুক জনতা যখন রয়েল রিসোর্টের কাছে জড়ো হয়, তাদের আবারও ধাওয়া করে পুলিশ, ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
রাত ১১টার পর থেকে রয়েল রিসোর্টের গেটের সামনে র্যাব ও পুলিশ আরও সতর্ক অবস্থান নেয়। রিসোর্টের গেটের সামনে শতাধিক পুলিশ সদস্য এবং র্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়। থেমে থেমে পুলিশকে ফাঁকা গুলি ছুড়তেও দেখা যায়। রিসোর্টের গেটে গিয়ে দেখা যায়, সামনের অংশের দেওয়াল এবং গ্লাসগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে।
আতঙ্কিত নারায়ণগঞ্জ
হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় অনেকটা আতঙ্কের মধ্য দিয়েই রাত কাটাচ্ছেন করোনায় জর্জরিত নারায়ণগঞ্জের মানুষ। সোনারগাঁয়ের প্রতিটি বাড়ির বাইরেই ভিড় করে সবাই পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছেন।
মাহমুদ লিয়াকত নামে সোনারগাঁয়ের খাসনগর দিঘীরপারের এক ব্যক্তি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৫৬ বছর ধরে এখানে আছি। আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনেক মারামারি দেখেছি। তবে এত আগুন আর ভাঙচুর কখনও দেখিনি। এমন গুলির শব্দও শুনিনি। খুব ভয় পেয়েছি। রাতেও পুলিশ এলাকায় পাহারা দিচ্ছে, জানি না কী হয়।
জাহান আরা বেগম নামে সোনারগাঁও এলাকার এক তাঁতি বলেন, ‘এলাকায় কয়েকদিন পরপরই মারামারি হয়, পুলিশ আসে। তবে রাস্তায় রাস্তায় আগুন ভাঙচুর কখনও দেখিনি। ঘটনার পর থেকেই গেট আটকিয়ে বাসায় বসে ছিলাম। এখন বের হয়ে দেখলাম রাস্তায় কাঁচের টুকরো আর আগুনের ধ্বংসাবশেষ।’
রিসোর্টের পাশের চা দোকানদার আয়নাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, রিসোর্টের অনেকেই প্রতিদিন আমার দোকানে চা খেতে আসে। সন্ধ্যায়ও কয়েকজন ছিল। তখনই হেফাজতের লোকজন দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। এই দৃশ্য দেখে দুই অতিথি রিসোর্টে না গিয়ে সরাসরি অন্যদিকে পালিয়ে যান। আমরাও দোকান রেখে পালিয়ে যাই। কিছুক্ষণ পর দেখি এলাকায় সব তছনছ।
সোনারগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি), সার্কেল এএসপি, নারায়ণগঞ্জ রেঞ্জের ডিআইজিসহ ঊর্ধ্বতন ৬ কর্মকর্তার কথা হয় ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। তবে তারা হামলা কিংবা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে নারাজ।
এর আগে সোনারগাঁওয়ের রয়েল রিসোর্টের ৫০১ নম্বর কক্ষে নারীসহ মামুনুল হককে অবরুদ্ধ করে স্থানীয়রা। পরে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ। সেই সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই নারীকে দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করেন মামুনুল হক।
মামুনুল হক অবরুদ্ধ এমন খবর শুনে সেখানে সন্ধ্যার পর জড়ো হতে থাকেন হেফাজতের নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে রয়েল রিসোর্টে হামলা চালান তারা। এতে রিসোর্টের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আতিকুল ইসলাম, এসিল্যান্ড গোলাম মোস্তফা মুন্না, নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) টিএম মোশাররফ হোসেন, সোনারগাঁ থানার ওসি (তদন্ত) তবিদুর রহমানসহ স্থানীয় সাংবাদিকরা। একপর্যায়ে মাওলানা মামুনুল হককে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যান বিক্ষুব্ধ হেফাজতের কর্মীরা। পরে মিছিল করেন তারা।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোশাররফ হোসেন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মামুনুল হককে থানায় নেওয়ার পথে রিসোর্টে হামলা চালান হেফাজতের কর্মীরা। পরে মামুনুল হককে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। সেখানে হামলা চালিয়ে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যান হেফাজতের কর্মীরা।
এআর/এমএসি/এমএইচএস/এসএসএইচ