সংযোগ সড়ক ছাড়া সেতু বা কালভার্ট নির্মাণ করা যাবে না
- রাস্তা ছাড়া সেতু নির্মাণে সরকারের লাখ-লাখ টাকা অপচয়
- কারো কারো ব্যক্তিগত স্বার্থে এসব সেতু নির্মাণ
- প্রকল্প ঠিকমতো পরিদর্শন করেন না অনেক কর্মকর্তা
- প্রস্তাব পাঠানোর আগে সরেজমিনে পরিদর্শন করার নির্দেশ
দুই পাশে কোনো রাস্তা নেই। তবুও হয়েছে সেতু। এসব সেতু নির্মাণের মাধ্যমে সরকারের লাখ লাখ টাকা অপচয় করা হয়েছে। এ অনিয়ম বন্ধে দেশের সব উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর (ডিডিএম)।
দুই পাশে রাস্তা নেই, ফসলের মাঠে ৩৮ লাখ টাকার সেতু
আশপাশে নেই কোনো বসতবাড়ি। নেই চলাচলের কোনো রাস্তাও। তবুও ফসলের মাঠে ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি সেতু। এতে ক্ষোভ বিরাজ করছে স্থানীয়দের মধ্যে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ সুন্দর খাতা গ্রামে সংযোগ সড়কবিহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সেতুটি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সুন্দর খাতা গ্রামের পশ্চিম পাশে ফসলের মাঠের যে অংশে সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে তার দুই পাশে কোনো রাস্তা নেই। তবে স্থানীয় কৃষকরা শুনেছেন, সেতুর দুই পাশে সড়ক তৈরি হবে। কিন্তু তা কবে হবে এবং কেন হবে, তারা কেউ জানেন না।
কয়েকজন কৃষক জানান, এ সেতুটি কোনো কাজে আসবে না। অপ্রয়োজনে সরকারের লাখ লাখ টাকা জলে ফেলা হয়েছে। সেতুর এক পাশে বসতবাড়ি থাকলেও অন্য পাশে ফসলের মাঠ। সামনে প্রায় এক কিলোমিটারের মধ্যে বসতবাড়ি নেই। জনসাধারণের চলাচল নেই।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে সেতুর প্রয়োজন। অথচ আশপাশে সড়ক নেই, বাড়িঘরও নেই এমন স্থানে সেতু হয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এই অপ্রয়োজনীয় সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে।
সুন্দর খাতা গ্রামের বাসিন্দা আবদেছ আলী বলেন, সড়ক ও বসতি না থাকায় সেতুটি নির্মাণের শুরুতে কাজ বন্ধ করে সব মালপত্র ফেরত নিয়ে যান প্রকৌশল অফিসের লোকজন। পরে শুনেছি অনেক তদবিরের পর আবার কাজ শুরু হয়।
মধ্যম সুন্দর খাতা গ্রামের ইউসুফ আলী বলেন, মানুষ নয়, গরু-মহিষ পারাপারের জন্য এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। আগে দেখতাম সড়ক নির্মাণের পর ব্রিজ বা কালভার্ট হতো। এক্ষেত্রে হয়েছে উল্টোটা।
উপজেলা প্রকৌশলী শফিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে ছিলাম। বিষয়টি আমার জানা নেই। তারপরও রাস্তা ছাড়া কী কারণে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হবে।
রাস্তা ছাড়াই নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সেতু
নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সেতু। তবে সেতুতে ওঠার জন্য নেই কোনো সড়ক। দুই পাশে বাঁশের সাঁকো দিয়ে উঠতে হয় সেতুতে। এভাবে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে কয়েকটি গ্রামের হাজারো মানুষ। এক দুই বছর নয়, ৯ বছর ধরে চলছে তাদের এই দুর্ভোগ।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নের কালী নদীর ওপর অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত সেতুটি চরম জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে জনগণের স্বার্থে সেতু নির্মাণ করা হলেও নেই সংযোগ সড়ক। অন্যদিকে নদীর তুলনায় সেতু ছোট হওয়ায় বর্ষায় পানির চাপে সংযোগ সড়ক ভেসে যায়। বাঁশের সাঁকো দিয়ে সেতুতে উঠতে হয়। ৯ বছরেও এই দুর্ভোগের সমাধান হয়নি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, জোয়ারদারপাড়া, শালঘর মধুয়া, কাচারীপাড়া, দুধকুমড়া, খালপাড়া বাজারসহ আশপাশের গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ বাঁশের সাঁকো দিয়ে সেতুতে উঠে চলাচল করছেন। অপরিকল্পিতভাবে সেতু নির্মাণ করায় সরকারের লাখ লাখ টাকা অপচয় হচ্ছে। সেতুটি জনদুর্ভোগের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। দ্রুত সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে পণ্য পরিবহন ও মানুষের যাতায়াতের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সেতু-কালভার্ট কর্মসূচির আওতায় ৩৬ ফুট দৈর্ঘ্যের সেতুটি ২৫ লাখ ৫০ হাজার ৫৩২ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে নির্মিত হওয়া সেতুটির দুই পাশে এখনো কোনো রাস্তা নির্মাণ করা হয়নি। সেতুর দুই পাশের সংযোগ সড়ক ছাড়াই প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়। ফলে সেতুটি ওই অঞ্চলের মানুষের চলাচলের কোনো কাজেই আসছে না।
স্থানীয় আমিন হোসেন বলেন, সংযোগ সড়ক বাদেই নদীর মাঝে অপরিকল্পিতভাবে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ৯ বছর ধরে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
কুমারখালীর ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সাইদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সেতু-কালভার্ট কর্মসূচির আওতায় ৩৬ ফুট দৈর্ঘ্যের সেতুটি ২৫ লাখ ৫০ হাজার ৫৩২ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে নির্মিত হওয়া সেতুটির দুই পাশে এখনো রাস্তা নির্মাণ করা হয়নি। সড়কের জন্য বরাদ্দ চেয়ে চাহিদা পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সড়কটি মেরামত করা হবে।
সরেজমিনে প্রকল্প ঠিকমতো পরিদর্শন করেন না অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা খবর নিয়ে দেখেছি, অনেক সময় সরেজমিনে পরিদর্শন না করেই সেতু নির্মাণের জন্য প্রস্তাব পাঠান প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা। আবার কারো কারো ব্যক্তিগত স্বার্থেও রাস্তাঘাট ছাড়া সেতু নির্মাণ করা হয়। এতে সরকারের অনেক টাকা অপচয় হচ্ছে।
অনিয়ম বন্ধে পাঁচ নির্দেশনা
রাস্তা ছাড়া সেতু নির্মাণ যাতে না হয়, সে বিষয়ে দেশের সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর (ডিডিএম)। সম্প্রতি তাদেরকে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়।
এতে বলা হয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর (ডিডিএম) থেকে বাস্তবায়নাধীন ‘গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মি. দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সেতু/কালভার্ট নির্মাণ (সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে দেশব্যাপী সেতু/কালভার্ট নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। উপজেলা থেকে সেতু/কালভার্ট নির্মাণের প্রস্তাব কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিনে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া পাঠানো হলে অপ্রয়োজনীয় বা কম গুরুত্বপূর্ণ সেতু/কালভার্ট নির্মাণের প্রস্তাব পাওয়া যায়। এছাড়াও সংযোগ সড়ক সঠিকভাবে না থাকায় নির্মিত সেতু/কালভার্টটি যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে কখনো কখনো নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হয়। ফলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
চিঠিতে বলা হয়, এ অবস্থায় উপজেলা থেকে প্রস্তাব পাঠানোর আগে প্রতিটি সেতু/কালভার্টের নির্মাণ স্থলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সরেজমিনে উপস্থিত হয়ে হাইড্রোলিক ডাটা পূরণ করে উপজেলা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটির সুপারিশ নিয়ে কেবল বাস্তবায়নযোগ্য সেতু/কালভার্টের প্রস্তাব পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। সীমিত রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত ও জনস্বার্থে সেতু/কালভার্ট নির্মাণের লক্ষ্যে হাইড্রোলিক ডাটা পূরণের সময় নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে।
১) সেতু/কালভার্ট নির্মাণস্থলে উভয় পাশে যথোপযুক্ত সংযোগ সড়ক অবশ্যই থাকতে হবে।
২) খালের প্রকৃত চওড়া অনুযায়ী প্রস্তাবিত সেতুর দৈর্ঘ্য (স্প্যান) সঠিক হতে হবে, কোনো অবস্থাতেই খালের দুই পাশ সংকুচিত করে প্রস্তাব পাঠানো যাবে না।
৩) সংযোগ সড়কের তুলনায় সেতুর উচ্চতা সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
৪) যেসব সেতু/কালভার্টের নিচে দিয়ে নৌযান চলাচল করবে, তা হাইড্রোলিক ডাটাসিটে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে।
৫) বিরোধপূর্ণ স্থানে সেতু/কালভার্ট নির্মাণের প্রস্তাব করা যাবে না।
উপযুক্ত স্থানে যাতে সেতু নির্মাণ করা হয় সেজন্য এ চিঠি
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে মহাপরিচালক (ডিজি) মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংযোগ সড়ক ছাড়া যাতে কোনো সেতু নির্মাণ করা না হয়, সেজন্য এ চিঠি পাঠানো হয়েছে। আমরা চাই উপযুক্ত স্থানে যাতে সেতু নির্মাণ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি আজ সভায় বসেছি। সভায়ও সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি বলেছি।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা পোস্টের নীলফামারী প্রতিনিধি শরিফুল ইসলাম এবং কুষ্টিয়া প্রতিনিধি রাজু আহমেদ।
/এসএইচআর/এসএসএইচ/