২৩৯ দিন পর নারায়ণগঞ্জের পুরনো লাইনে ট্রেন, প্রকল্পে এখনও জটিলতা
পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে গেন্ডারিয়ার অংশে তিনটি পৃথক রেল লাইনের নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য ২০২২ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। সে সময় বলা হয়েছিল, ৪ ডিসেম্বর থেকে ৩ মার্চ অর্থাৎ ৮৯ দিন বন্ধ থাকবে ওই রুটের ট্রেন চলাচল। দীর্ঘ ৮৯ দিন পার হওয়ার পর দফায় দফায় মাসখানেক পর চালু হবে বলে জানানো হলেও কাজ শেষ না হওয়ায় ওই রেলপথে আর ট্রেন চালাতে পারেনি বাংলাদেশ রেলওয়ে। অবশেষে নারায়ণগঞ্জবাসীর যাতায়াতের দুর্ভোগ লাঘব করতে ২৩৯ দিন (৭ মাস ২৭ দিন) পর মঙ্গলবার (১ আগস্ট) ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে আবারও চালু হতে যাচ্ছে ট্রেন চলাচল।
ট্রেন চলাচলের জন্য ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন কর্তৃপক্ষ। আর এতে নারায়ণগঞ্জ রুটের নিয়মিত যাত্রীদের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার হয়েছে। তারা বলছেন, আবারও কম খরচে নিরাপদ যাত্রার দিন শুরু হতে যাচ্ছে।
কিন্তু ট্রেন চলাচল শুরু হলেও তেমন গতি বাড়বে না ওই রেলপথের যাত্রীদের। কারণ ট্রেনগুলো চলবে ১৩৮ বছরের পুরনো মিটারগেজ লাইনেই। তাই ট্রেনগুলো ছুটে চলবে আগের কচ্ছপের মতোই।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত এক জোড়া ডেমোসহ মোট ৯ জোড়া ট্রেন চলাচল করত। তবে আগামীকাল থেকে ঠিক কতটি ট্রেন চলাচল করবে তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি স্টেশন কর্তৃপক্ষ।
এদিকে ঐতিহাসিক পুরাতন ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ রেলপথ উন্নত করতে ২০১৪ সালে ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেললাইন প্রকল্প’ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তখন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৭৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। কিন্তু প্রকল্প গ্রহণের ৮ বছর ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও ওই পথের দ্বিতীয় রেললাইন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি এখনও। তৈরি হয়েছে নতুন জটিলতা। চুক্তি বাতিল করেছে ওই প্রকল্পের এক ঠিকাদার।
প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ না হওয়ায় তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। প্রকল্পটি বর্তমানে ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা আছে। প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
পুরনো রেলপথেই চলবে ট্রেন
রেলপথে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব ১২ কিলোমিটারের সামান্য বেশি। ব্রিটিশ আমলের তৈরি একটি মিটারগেজ রেলপথ দিয়েই এখনও এ সেকশনে ট্রেন চালানো হচ্ছিল। তিনটি প্যাকেজে কাজ চলা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেললাইন প্রকল্পের ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তথ্যানুসারে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৮২ শতাংশ। তাই নতুন লাইনে ট্রেন চালানো যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. সেলিম রউফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত যে পুরাতন সিঙ্গেল লাইন ছিল, সে লাইনেই আবার ট্রেন চালু করা হবে। নতুন করে যে ডুয়েলগেজ লাইন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, সেটি শেষ হবে ২০২৬ সালের জুন মাসে। নতুন লাইনটি চালু হলে তখন আবার পুরাতন লাইন সংস্কারের কাজ শুরু হবে।
প্রকল্পে যে জটিলতা
প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে গত ১৫ মার্চ চুক্তি সমাপ্তির নোটিশ পাঠিয়েছে পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন অব চায়না (পিসিসিসি)। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সময়মত অর্থ না পাওয়া এবং প্রকল্পের জায়গা হস্তান্তর না করায় কাজটি তারা আর করতে পারছেন না। রেললাইন স্থাপনসহ সিভিল কাজের ঠিকাদার ছিল প্রতিষ্ঠানটি।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন ও পাগলা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ২ কিলোমিটার রেলপথের জায়গার জন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন এখনও জায়গা হস্তান্তর করেনি।
এ প্রসঙ্গে মো. সেলিম রউফ বলেন, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চুক্তি সমাপ্তির জন্য নোটিশ পাঠিয়েছিল, তবে সেটি আর ঠিক হয়নি। তারা কাজটি আর করেনি। সামনে টেন্ডার দিয়ে নতুন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নেওয়া হবে তখন থেকে আবার কাজ শুরু হবে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে এ বছরের শেষ নাগাদ আগামী বছরের শুরুতে জমি বুঝে পেলে তারপরে কাজের সমাপ্তি করা যাবে।
ট্রেন চলাচলের প্রস্তুতি ও যাত্রীদের উৎসাহের সঞ্চার
এদিকে নতুন করে ট্রেন চলাচল শুরু হতে যাওয়ায় উৎসাহের সঞ্চার হয়েছে ওই অঞ্চলের যাত্রীদের মধ্যে। যারা নিয়মিত নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা এসে অফিস করেন তারা যেন আবারও প্রাণ ফিরে পেলেন। অন্যদিকে শহরের প্লাটফর্ম পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে ট্রেন চলাচলের জন্য।
নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা বনি আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের কাছেই আমার বাসা। বাসা থেকে হেঁটেই স্টেশনে যেতে ৭-৮ মিনিট সময় লাগে। এদিকে আমার অফিস মগবাজারে। ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে পারি কোনো ধরনের যানজট ছাড়াই। এতে ভাড়াও লাগে কম। দীর্ঘদিন ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় যাতায়াতে একটু অসুবিধা হয়েছিল। কখনো কখনো অফিসে যেতে এক-দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যেত। আগামীকাল থেকে আবার স্বাচ্ছন্দ্যে অফিসে যাতায়াত করতে পারব, এটা জেনে খুব ভালো লাগছে।
প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার আফছার উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগামীকাল থেকে ঢাকা স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে যাবে এটা নিশ্চিত। সেইভাবে আমরা সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। তবে কত জোড়া ট্রেন প্রথমদিন চলাচল করবে সেটি এখনও জানানো হয়নি। আজ সন্ধ্যা নাগাদ এটি জানা যাবে।
এর আগে গত ২৫ জুলাই ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন থেকে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত ডুয়েলগেজ এবং গেন্ডারিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জ চাষাড়া পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ কাজের অগ্রগতি পরিদর্শনে যান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার কারণে কন্টাক্টর কাজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন প্রকল্প রিভাইজ করে একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন করে টেন্ডারিং করে দ্রুত কাজ শুরু হবে।
এমএইচএন/এফকে