ই-নামজারিতে বেশি সময় নিচ্ছে ৩৮ জেলা
সরকার-নির্ধারিত ২৮ দিনের মধ্যে ই-নামজারি আবেদন নিষ্পত্তি করছে না দেশের ৩৮ জেলার ভূমি অফিস। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় নেয় খুলনা জেলা। এ জেলায় ই-নামজারিতে গড় নিষ্পত্তির সময় ৭০ দিন। এ তালিকায় ৫৭ দিন সময় নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রংপুর এবং ৫৫ দিন সময় নিয়ে তৃতীয় স্থানে আছে যশোর জেলা।
জমি কিনলে বা নির্দিষ্ট কোনো উপায়ে জমির মালিক হয়ে থাকলে হালনাগাদ রেকর্ড সংশোধন করে নতুন মালিকের নামে জমি রেকর্ড করাকে নামজারি বলা হয়। এখন অনলাইনে নামজারি করা হয়। এ প্রক্রিয়াকে ই–নামজারি বলা হয়।
২০১৬ সালে পাইলট আকারে ই-নামজারি কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে সারা দেশে একযোগে শতভাগ ই-নামজারি বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। এখন তিনটি পার্বত্য জেলা ছাড়া বাকি ৬১ জেলার সব উপজেলা ভূমি ও সার্কেল অফিস এবং ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ই-নামজারি চালু রয়েছে।
ই-নামজারিতে সময় বেশি লাগার কারণ কী?বিভিন্ন জেলার দায়িত্বরত কালেক্টররা (মূলত ডিসি) বলছেন, লোকবল সংকটের কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ই-নামজারি আবেদন নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। কয়েক মাসের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনার জেলা প্রশাসক (ডিসি) খন্দকার ইয়াসির আরেফীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ই-নামজারি আবেদন নিষ্পত্তির সময় বর্তমানে কমে এসেছে। আগে ৯৮ দিন ছিল। আমরা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছি।
তিনি বলেন, মাঝে কিছু সহকারী কমিশনার (ভূমি) ছিলেন না। এছাড়া লোকবলের কিছু ঘাটতি ছিল, এ সমস্যা থাকবে না। আশা করছি আগামী ২ মাসের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
যশোরের ডিসি মো. তমিজুল ইসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের জেলায় ৮টি উপজেলা। এর মধ্যে ২/৩টি উপজেলায় নির্ধারিত তারিখের বেশি সময় লাগে না। যেগুলোতে বেশি সময় লাগছে, সেগুলোতে লোকবলের সংকট আছে। যেমন অনেক জায়গায় সার্ভেয়ার নেই। নামজারির ক্ষেত্রে সার্ভেয়ার লাগে। একজন সার্ভেয়ার কখনো কখনো ২টি উপজেলায় একত্রে দায়িত্ব পালন করেন। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ও জানে।
তিনি বলেন, আমাদের পুরোনো কিছু আবেদন ছিল। সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে একটা পর্যায়ে আছি। এখন প্রতি মাসে যে পরিমাণ আবেদন পড়ে, তার তুলনায় বেশি সম্পন্ন করি। আশা করছি আগামী ২-১ মাসের মধ্যে একটা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে চলে আসবে।
অতিরিক্ত সময় নেয় যেসব জেলা
ঢাকা বিভাগের ৪টি জেলা ই-নামজারি আবেদন নিষ্পত্তিতে বেশি সময় নিচ্ছে। সেগুলো হলো- মুন্সীগঞ্জ (২৯ দিন), ফরিদপুর (৩০ দিন), গোপালগঞ্জ (৩২ দিন), গাজীপুর (৩৮ দিন)।
চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম (২৯ দিন), লক্ষ্মীপুর (৩২ দিন), নোয়াখালী (৩৩ দিন), কক্সবাজার (৪৮ দিন); ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোণা (২৯ দিন), ময়মনসিংহ (২৯ দিন), জামালপুর (৩০ দিন); সিলেট বিভাগের সিলেট (৩৪ দিন), সুনামগঞ্জ (৩৭ দিন); রাজশাহী বিভাগের বগুড়া (৩২ দিন), পাবনা (৩৩ দিন), জয়পুরহাট (৩৪ দিন), নওগাঁ (৩৭ দিন) ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ (৩৯ দিন) তুলনামূলক বেশি সময় নেয়।
বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি (৩০ দিন), পিরোজপুর (৩৩ দিন), পটুয়াখালী (৪০ দিন), বরিশাল (৪০ দিন); রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা (৩১ দিন), কুড়িগ্রাম (৩৪ দিন), পঞ্চগড় (৩৬ দিন), দিনাজপুর (৩৭ দিন), নীলফামারী (৩৭ দিন), লালমনিরহাট (৩৯ দিন), রংপুর (৫৭ দিন); খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া (২৯ দিন), চুয়াডাঙ্গা (২৯ দিন), নড়াইল (৩২ দিন), বাগেরহাট (৩৮ দিন), সাতক্ষীরা (৪১ দিন), মেহেরপুর (৪৫ দিন), মাগুরা (৪৭ দিন), যশোর (৫৫ দিন) ও খুলনা (৭০ দিন) জেলা ই-নামজারি আবেদন নিষ্পত্তিতে বেশি সময় নিচ্ছে।
নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তি করছে যেসব জেলা
ঢাকা বিভাগের ঢাকা (১৪ দিন), শরীয়তপুর (২৪ দিন), মানিকগঞ্জ (২৫ দিন), নরসিংদী (২৬ দিন), টাঙ্গাইল (২৬ দিন), রাজবাড়ী (২৬ দিন), মাদারীপুর (২৮ দিন), কিশোরগঞ্জ (২৮ দিন), নারায়ণগঞ্জ (২৮ দিন); চট্টগ্রাম বিভাগের চাঁদপুর (১৮ দিন), ফেনী (২১ দিন), কুমিল্লা (২৫ দিন), ব্রাহ্মণবাড়িয়া (২৭ দিন); ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর (১৮ দিন); সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার (২৭ দিন), হবিগঞ্জ (২৮ দিন), রাজশাহী বিভাগের নাটোর (২৭ দিন), রাজশাহী (২৮ দিন), সিরাজগঞ্জ (২৮ দিন); বরিশাল বিভাগের বরগুনা (২২ দিন), ভোলা (২৩ দিন), রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁও (২৫ দিন) এবং খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ (২৬ দিন) জেলা নির্ধারিত সময়ে ই-নামজারি আবেদন নিষ্পত্তি করছে।
ঢাকার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, আমরা ১৪ দিনের ভেতরেই নামজারি করছি। এ বিষয়ে ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় নেই। অনলাইনে আবেদন করলে ঝুলিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই। আবেদন গ্রহণ করবে নয়তো খারিজ করে দেবে, কিন্তু ঝুলিয়ে রাখার উপায় নেই।
তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, জায়গার নথি হারিয়ে যায় বা পুড়ে যায়। অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করে। তাই আমরা চেষ্টা করছি সকল জমির ছায়া নথি তৈরি করার। নথি হারিয়ে গেলেও যাতে এগুলো পাওয়া যায়।
ই-নামজারির আবেদন কীভাবে করতে হয়?
ভূমির ই-নামজারি করার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে (https://land.gov.bd/) যেতে হবে। এরপর অনলাইন নামজারি সিস্টেমে ঢুকে ‘অনলাইনে আবেদন করুন’ ও ‘আবেদন ট্র্যাকিং’ নামে দুটি অংশ দেখা যাবে। বাম পাশে ‘অনলাইনে আবেদন করুন’ অংশের নিচে ‘নামজারি আবেদনের জন্য ক্লিক করুন’ লেখায় ক্লিক করে আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হবে।
আবেদন ফরমের প্রথমেই নামজারির জন্য আবেদন করা জমিটি ক্রয়, ওয়ারিশ, হেবা, ডিক্রি, নিলাম, বন্দোবস্ত, অন্যান্য কোন সূত্রে মালিকানা পাওয়া গেছে তা চিহ্নিত করতে হবে। জমির তথ্য অংশে ক্রমান্বয়ে বিভাগ, জেলা, উপজেলা সিলেক্ট করার পর মৌজা সিলেক্ট করতে হবে। মৌজার দীর্ঘ তালিকা থেকে নির্দিষ্ট মৌজাটি খুঁজে পেতে মৌজার নাম ও জেএল নম্বর মনে রাখতে হবে। নামজারির আবেদন সর্বশেষ জরিপ রেকর্ডের ভিত্তিতে হবে। সেজন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার জন্য এসএ/এমআরএস, আরএস/বিএস, মহানগর, দিয়ারা, সিএস যা প্রযোজ্য জরিপটি সিলেক্ট করতে হবে।
জমির খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, জমির পরিমাণ, খতিয়ানে সংশ্লিষ্ট দাগে জমির পরিমাণ টাইপ করে দিতে হবে। একইভাবে একই খতিয়ান থেকে বা একই মৌজাভুক্ত একাধিক খতিয়ান থেকে ‘আরও দাগ’ আরও জমি এ নামজারির সঙ্গে যুক্ত করতে হলে সেক্ষেত্রে ‘আরও খতিয়ান সংযুক্ত করুন’ ও ‘আরও দাগ সংযুক্ত করুন’ চেপে আরও খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, আবেদিত জমির পরিমাণ, খতিয়ানে সংশ্লিষ্ট দাগে জমির পরিমাণ এসব তথ্য পূরণ করতে হবে।
ফরম পূরণের সময় যেসব তথ্য দিতে হয়
দলিলসূত্রে জমির মালিক হলে দলিল নম্বর, দলিলের তারিখ ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নাম উল্লেখ করতে হবে। খতিয়ানে রেকর্ড মালিক বা মালিকদের নাম, পিতা/স্বামীর নাম ও পূর্ণ ঠিকানা দিতে হবে। আবেদনকারী বা আবেদনকারীদের নাম ও পূর্ণ ঠিকানা, সক্রিয় মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর (পাসপোর্ট/জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র নম্বর) ও ই-মেইল এড্রেস উল্লেখ করতে হবে।
আবেদনকারী যদি যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানের নাম, প্রতিনিধির নাম, প্রতিনিধির জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্ম তারিখ, মোবাইল নম্বর, পদবি, প্রতিষ্ঠানের আরজেএসসি রেজিস্টেশন নং, নিবন্ধন তারিখ, জেলা, উপজেলা, ঠিকানা সরবরাহ করতে হবে।
আবেদনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা হলে প্রতিষ্ঠানের নাম, প্রতিনিধির নাম, প্রতিনিধির জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্ম তারিখ, মোবাইল নম্বর, পদবি উল্লেখ করতে হবে।
আবেদনকারী আরজেএসসি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হলে প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা, প্রতিনিধির নাম, প্রতিনিধির জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্ম তারিখ, মোবাইল নম্বর, পদবি দিতে হবে।
আবেদনকারী নিজে না হয়ে প্রতিনিধির মাধ্যমে আবেদন করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধির নাম ও পূর্ণ ঠিকানা, সক্রিয় মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর (একইভাবে পাসপোর্ট/জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র নম্বর), ই-মেইল এড্রেস, বয়স ও আবেদনকারীর সঙ্গে সম্পর্কের তথ্য দিতে হবে।
জমি দাতা বা দাতা মৃত হলে তার ওয়ারিশের এবং দাতা কোনো প্রতিষ্ঠান হলে প্রতিনিধির নাম ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্ম তারিখ ও মোবাইল নম্বর, পদবি, আরজেএসসি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন নম্বর, তারিখ, জেলা, উপজেলা, ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে।
আবেদন ফি কত টাকা?
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ই-নামজারি আবেদন ফি (কোর্ট ফি) ২০ টাকা ও নোটিশ ফি (নোটিশ জারি ফি) ৫০ টাকা। মোট ৭০ টাকা আবেদন করার সময়ই অনলাইনে দিতে হয়। এছাড়া রেকর্ড সংশোধন ফি এক হাজার টাকা ও খতিয়ান সরবরাহ ফি ১০০ টাকা। চার ধরনের ফি মিলিয়ে নামজারির জন্য প্রকৃত খরচ ১ হাজার ১৭০ টাকা।
যেভাবে ফি পরিশোধ করা যাবে
নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে নগদ, রকেট, বিকাশ, উপায়, ভিসা কার্ড, মাস্টার কার্ডসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে ফি পরিশোধ করা যাবে।
অনিয়ম হলে
ই-নামজারির বিষয়ে যেকোনো অনিয়ম হলে কল সেন্টারে (১৬১২২) ফোন করে এবং ওয়েবসাইটে (https://hotline.land.gov.bd/) অভিযোগ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো যাবে। কর্তৃপক্ষ অবিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।
এসএইচআর/ওএফ