ঘনিয়ে আসছে হজ, ঘনীভূত হচ্ছে সংকট
হজের সময় যত এগিয়ে আসছে তত ঘনীভূত হচ্ছে নানা সংকট। হজ এজেন্সিগুলোর গাফিলতি, ৩০ শতাংশ হজযাত্রীকে মদিনায় পৌঁছানোর শর্ত, ভিসা না হওয়ায় একের পর এক হজ ফ্লাইট বাতিল এবারের হজযাত্রার সার্বিক পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে।
সবশেষ তথ্যানুযায়ী ৭টি ফ্লাইট বাতিল এবং ভিসা জটিলতায় ৩ হাজারের বেশি হজযাত্রী নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী সৌদিতে যেতে পারেননি।
এদিকে কমদামে বাড়ি খুঁজতে গিয়ে শেষ সময় পর্যন্ত হজযাত্রীদের ভিসা করাতে অপেক্ষা করছে এজেন্সিগুলো। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শেষ সময়ে ফ্লাইটের চাপ বাড়বে। এতে ফ্লাইট বিপর্যয়ের শঙ্কা করছে এয়ারলাইন্সগুলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ মে প্রথম হজ ফ্লাইটের দিনই ভিসা জটিলতায় ১৪০ জন হজযাত্রী সৌদি যেতে পারেননি। এরপর ভিসা না পাওয়া, সৌদিতে বাড়ি ভাড়া না করেই ফ্লাইট বুকিং করায় ৭টি হজ ফ্লাইট বাতিল করতে হয়েছে। সামনে হজ ফ্লাইট বাতিলের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়ুন >> ভিসা জটিলতায় সৌদি আরবের লাল তালিকার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
এ পরিস্থিতির জন্য হজ এজেন্সিগুলো ধর্ম মন্ত্রণালয়কে, আর মন্ত্রণালয় হজ এজেন্সিগুলোকে দায়ী করছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, হজ নিয়ে এখন পর্যন্ত যে সংকট দেখা দিয়েছে তার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হজ এজেন্সিগুলো। তারা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানেনি। আমাদের সঙ্গে কোনো সমন্বয়ও করেননি। একে একে ফ্লাইট বাতিল করায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। শেষ সময়ে হজযাত্রীর চাপ বাড়লে ফ্লাইট শিডিউলে বিপর্যয় তৈরি হতে পারে।
জানতে চাইলে হজ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মতিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক এজেন্সির অতিরিক্ত লোভের কারণে বাংলাদেশের হজ কার্যক্রম লাল তালিকাভুক্তির ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছিল। মঙ্গলবার সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় থেকে আজকের মধ্যে ৮০ শতাংশ ভিসা না করাতে পারলে বাংলাদেশ লাল তালিকাভুক্ত হতে পারে এমন বার্তাও দেওয়া হয়েছে।
তার অভিযোগ, কমদামে বাড়ি খুঁজতে গিয়ে শেষ সময় পর্যন্ত হজযাত্রীদের ভিসা করাতে অপেক্ষা করছে এজেন্সিগুলো। এতে এখন ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে। শেষ সময়ে যাত্রীর চাপের কথা চিন্তা করে বিমান থেকে অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনার জন্য আবেদন করা হয়েছে। যেসব হজ এজেন্সি নির্দেশনা মানছে না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
বাড়ি ভাড়া না করাতেই সংকটের শুরু
মক্কা-মদিনায় বাড়ি ভাড়া, মোয়াল্লেমসহ সৌদি আরবের দেওয়া বিভিন্ন শর্ত পূরণ করে হজযাত্রীদের ভিসা করতে হয়। কিন্তু হজ এজেন্সিগুলোকে তিন দফা নোটিশ দিয়েও বুধবার পর্যন্ত ২২ শতাংশ হজযাত্রীর ভিসা করাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এর পেছনে বড় কারণ, প্রাইভেট এজেন্সিগুলো সৌদিতে বাড়ি ভাড়া করতে না পারা।
হজ সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্দিষ্ট সময়ে ভিসা না করতে পারায় ৯৮টি এজেন্সিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ এজেন্সির ভিসার হার ৬০ শতাংশের ঘরে। তারা সৌদিতে কম টাকায় বাড়ি ভাড়া খুঁজছে। তাদের আশা শেষ সময়ে কম টাকায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে। তাই আরেকটু অপেক্ষা করছে। এমন করতে করতে শেষ সময়ে এসেও তারা বাড়ি ভাড়া করছে না। যদিও বুধবারের মধ্যে ৮০ শতাংশ ভিসা করাতে না পারলে অভিযুক্ত হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়ে রেখেছে মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, অন্তত ১০০ হজ এজেন্সি কম টাকায় বাড়ি ভাড়া খুঁজতে গিয়ে এখনো বাড়ি ভাড়া করতে পারেনি। ফলে এসব এজেন্সির প্রায় ৫০ হাজার হজযাত্রীর ভিসা এখনো হয়নি। দ্রুত বাড়ি ভাড়া শেষে হজযাত্রীর ভিসা সম্পন্ন না হলে তাদের হজযাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
সম্প্রতি বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত অনিয়মের কারণে ইউরো ও কোবা এয়ার ইন্টারন্যাশনালের মালিক ও ছেলে সৌদি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই মালিকের অধীন ৮২৩ হজযাত্রীর হজযাত্রাও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
মদিনায় ৩০ শতাংশ হজযাত্রী পৌঁছানো নিয়ে জটিলতা
২১ মে প্রথম হজ ফ্লাইট শুরু হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত (৭ জুন রাত ১টা ৫৯ মিনিট) ৫৯ হাজার ৬৫৫ জন হজযাত্রী সৌদি আরব পৌঁছেছেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৯ হাজার ৩৫০ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গেছেন ৫০ হাজার ৩০৫ জন।
হজ সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার ফ্লাইট সংকট তৈরি হয়েছে নতুন শর্তের কারণেও। চলতি বছর নতুন শর্ত অনুযায়ী, মোট হজযাত্রীর ৩০ শতাংশ মদিনায় নামাতে হবে। এমন শর্ত দেওয়ার পর জটিলতা শুরু হয়। এর জন্য হজ মন্ত্রণালয়ের নীতিকে দায়ী করছে হজ এজেন্সিগুলো।
বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, ৯০ শতাংশ হজযাত্রী মক্কা দিয়ে প্রবেশ করে এবং মদিনা দিয়ে বের হন। এবার মদিনা দিয়ে ৩০ শতাংশ হজযাত্রী প্রবেশের যে শর্ত দেওয়া হয়েছে তা কেন করা হলো সে ব্যাখ্যা চায় হজ এজেন্সিগুলো। এখন পর্যন্ত যে কয়টি হজ ফ্লাইট বাতিল হয়েছে প্রায় সবগুলোই মদিনাগামী ফ্লাইট।
তবে এজন্য হজ এজেন্সি ও এয়ারলাইন্সের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন হজ অফিসের (আশকোনা) পরিচালক সাইফুল। তিনি বলেন, হজ চুক্তি করার সময় ধর্ম মন্ত্রণালয়, হজ এজেন্সি ও হাব সব অংশীজনরা থাকেন। সবার মতামত নিয়ে হজের চুক্তি হয়। এখন কেউ কেউ বলছেন, মদিনাগামী ৩০ শতাংশের বিষয়টি তারা জানতেন না। কেউ জানেন না, বিষয়টি সঠিক নয়।
তার মতে, হজযাত্রী বহন করা তিনটি এয়ারলাইন্সের শ্লট অনুসারে সমন্বয় করে ফ্লাইট শিডিউল করা আছে। এজেন্সিগুলোর উচিত ছিল, তারা যে সময় বাড়ি ভাড়া করছে ওই সময় সৌদিতে ফ্লাইট শিডিউল পাওয়া যাবে কি না তা সমন্বয় করা। মন্ত্রণালয়, হজ এজেন্সি এবং এয়ারলাইনসগুলো সমন্বয় করে যদি কাজ করত তাহলে যে ফ্লাইটগুলো বাতিল হয়েছে তা হতো না এবং সামনে ফ্লাইট শিডিউল বিপর্যয়ের যে শঙ্কা করা হচ্ছে তাও হতো না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, যে কয়টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে বেশিরভাগ মদিনাগামী ফ্লাইট। হজ অফিস ও মন্ত্রণালয় শুধু বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যারা যাচ্ছেন তাদের মদিনাগামী ফ্লাইটে দিচ্ছে। কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের মদিনায় কোনো ফ্লাইট দিচ্ছে না। এজন্য ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে। তারপরও ১০ হাজারের বেশি বেসরকারি হজযাত্রীকে মদিনাগামী ফ্লাইটে পাঠানো হয়েছে। যত সমস্যাই হোক, আশা করি সমাধান হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজিম বলেন, প্রথম ফ্লাইটে ১৪০টি সিট ফাঁকা গেছে। এতে বিশাল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। হজ এজেন্সিগুলোর উচিত ছিল তারা যেভাবে বাড়ি ভাড়া করেছে সেভাবে হজযাত্রীর সংখ্যা আমাদের দেওয়া। তারা বাড়ি ভাড়া না করেই ফ্লাইট বুকিং দিচ্ছে। পরে যাত্রী দিতে পারছে না। ফলে স্বাভাবিক কারণে বিমানের সিট ফাঁকা যাচ্ছে কিংবা না যাওয়ার সংখ্যা বেশি হওয়ায় ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে।
তিনি বলেন, হজযাত্রীদের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা আমরা রেখেছি। কিন্তু ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং হজ এজেন্সিগুলো আমাদের সহযোগিতা না করায় ঝামেলা হচ্ছে। শিডিউল পার হয়ে যাচ্ছে। এতে এয়ারলাইন্সেগুলো জরিমানার মুখে পড়ছে অথবা ফ্লাইট বাতিল করতে হচ্ছে।
অতিরিক্ত ৫টি ফ্লাইট পরিচালনা করার অনুমতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেহেতু ৭টি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে অনেক ফ্লাইটে সিট ফাঁকা গেছে, এখন এসব যাত্রীদের তো পরবর্তীতে বহন করতে হবে। এজন্য অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
বুধবার পর্যন্ত ভিসা পেয়েছেন ৭৮ শতাংশ হজযাত্রী
চলতি বছর এক লাখ ২২ হাজার ২২১ জন বাংলাদেশি পবিত্র হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে যাবেন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ হজযাত্রীর ভিসা ইস্যুর কাজ বুধবারের (৭ জুন) মধ্যে সম্পন্ন করতে বলেছে, সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়। কিন্তু সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ভিসা ইস্যু হয়েছে ৭৮ শতাংশ হজযাত্রীর। সরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রী ৯১ শতাংশ আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হজযাত্রীদের ৭৫ শতাংশ ভিসা পেয়েছেন।
বুধবার বিকেলে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, এখন পর্যন্ত মোট ৭৮ শতাংশ হজযাত্রীর ভিসা পেয়েছে। সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় শর্ত পূরণ করতে বাকি আছে মাত্র ২ শতাংশ। এই ২ শতাংশও পূরণ হয়ে যাবে। হজ এজেন্সিগুলোকে জানানো হয়েছে, যারা এখনো ভিসা করাননি তারা যেন আজকের মধ্যে ভিসা করিয়ে নেন।
এনএম/জেডএস