জুনিয়র হওয়াই কি দোষ ছিল এসএসসি পরীক্ষার্থী তাজুনের!
রাজধানীর দনিয়ার একে স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিল মুশফিক তাজুন। বুধবারও (১০ মে) পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফেরে। বিকেলে বন্ধুর ফোন পেয়ে বাসা থেকে বের হয় মুশফিক তাজুন (১৮)। কিন্তু সন্ধ্যার পর আড্ডায় গিয়ে অজানা কারণে খুন হতে হয় তাকে।
তবে পুলিশ বলছে, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে জেরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ধনিয়া কলেজের সামনে খুন হতে হয় তাজুনকে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এমন তথ্য দিয়েছে পুলিশ।
গ্রেপ্তাররা হলেন- মাহামুদুল হাসান নাহিন, ইয়ানুর রহমান শান্ত ও নাজমুস সাকিব। ঘটনার পর বুধবার গভীর রাতে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় নিহতের দুলাভাই মো. আশিকুর রহমান বাদী হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৩৯। মামলায় ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ৩ জনও দায়েরকৃত মামলার আসামি।
মামলার আসামিরা হলেন- মাহামুদুল হাসান নাহিন (১৭), ইয়ানুর রহমান শান্ত (১৭), নাজমুস সাকিব (১৭), শফিক ওরফে হাতভাঙ্গা শফিক (১৯), মাহফুজ (১৭), মো. সায়েম (১৭), মো. মাইনুল বিশাল (১৭), আবির (১৮), মোবাশ্বের ভূইয়া (১৭), অপূর্ব রায় (১৬), শাহরিয়া মুশফিক (১৭), মেশকাত (১৭), আদনান (১৭), তন্ময় (১৭), নাঈম (১৭), সাগর (১৬) ও ইমনসহ (১৬) অজ্ঞাতনামা আরও ৪/৫ জন।
মামলার বাদী ও নিহতের দুলাভাই মো. আশিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে, তাজুনের মতো ছেলে হয় না। এসএসসি পরীক্ষার জন্য সে বাসা থেকে কম বের হতো। আড্ডাতেও যেত না। পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী ছিল। গতকাল কী থেকে কী হয়ে গেল।
তিনি বলেন, তাজুনকে এভাবে খুন হতে হবে ভাবিনি। ওর কোনো দোষ ছিল না। ওর কারণে সঙ্গে কারো দ্বন্দ্ব ছিল না। এলাকায় খোঁজ নিলে সবাই বলবে ও কেমন ছেলে। আজ তাজুনের মৃত্যুতে পরিবারে শোকের ছায়া। একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে তার মা বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন।
তিনি বলেন, তাজুনের বাবা কাতার প্রবাসী। তাজুনের মা অসুস্থ, এমন খবর দিয়ে তার বাবা মো. মোশারফকে খবর দেওয়া হয়। তিনি আজ (বৃহস্পতিবার) ঢাকায় নেমেছেন। তাজুনের প্রথম জানাজা যাত্রাবাড়ীতে হয়েছে। এখন গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর শ্রীনগরে নেওয়া হচ্ছে। তাজুনের লাশ দেখার পর তার বাবাকে কীভাবে সামলাব সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।
নিহত মুশফিক তাজুনের স্কাউটের টিচার শাহাদাত হোসেন বলেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি সে স্কাউটিংয়ে যুক্ত ছিল। সে অনেক ভালো একজন ছাত্র ছিল। ভালো কাজে জড়িত ছিল এবং নম্র ভদ্র ছিল। বিভিন্ন জায়গায় গরীব বাচ্চাদের জামা কাপড় খাবার দাবার দিত। সে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করত। ঈদের সময় গরীব বাচ্চাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া ও বাচ্চাদের নিয়ে ঘোরাফেরা করত।
নিহত মুশফিক তাজুনের চাচা মানিক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ভাতিজাকে শাওন নামের একটি ছেলে তাকে ডেকে নিয়ে ছিল। পরে দনিয়া কলেজের সামনে এ ঘটনাটি ঘটে। ঢাকা মেডিকেলে এসে দেখি আমার ভাতিজা মারা গেছে। পুলিশ এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করেছে বলে জানতে পেরেছি।
মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. মনির হোসাইন বলেন, এ ঘটনায় জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছি। তিনজনকে আদালতে হাজির করে ৫ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে। ঘটনায় জড়িত অন্যান্যদের গ্রেপ্তারে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চলছে।
মামলার এজহার সূত্রে জানা যায়, তাজুনের বাবার নাম মো. মোশারফ ও মায়ের নাম পপি বেগম। জুরাইনের মুরাদপুর মাদ্রাসা রোডের ৮২/২ বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকত তাজুন।
বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তাজিন তার বন্ধু আরিফুল ইসলাম শাওনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে বাসা থেকে বের হয়েছিল। একই দিন বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে দনিয়া কলেজের সামনে তার বন্ধু আরিফুল ইসলাম শাওন (১৭), নাবিল হাসান (১৬), তাহসিন আহাম্মেদ শ্রাবণ (১৬), অর্নব হোসেন (১৭) ও রায়হানদের (১৭) সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল।
এমন সময় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ধারালো চাপাতি, চাকু, ছুরিসহ লাঠি-সোটা নিয়ে তাজুন ও তার বন্ধুদের ওপর অতর্কিত হামলা চালানো হয়। বিবাদীরা তাদেরকে এলোপাথাড়ি মারধর করতে থাকে। একপর্যায়ে ৪নং আসামি ধারালো ছুরি নিয়ে তাজুনের বাম পাশে বুকের নিচে ছুরিকাঘাত করলে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এ সময় জড়িতরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। তখন তার বন্ধুসহ অন্যান্য পথচারীরা তাজুনকে দ্রুত উদ্ধার করে দনিয়ার সালমান হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু অবস্থা খারাপ হওয়ায় দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এলোপাথাড়ি মারধরের কারণে নিহতের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত ও বুকের বাম পাশে ছুরিকাঘাতের কারণে রক্তাক্ত জখম হওয়ায় তাজুনের মৃত্যু হয় বলে ধারণা পুলিশের।
সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জেরে খুন তাজিন
যোগাযোগ করা হলে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মফিজুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ঘটনায় আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসেন মো. তামিম, ইয়াসিন আরাফাত, সায়েম ও শাওন। এদের মধ্যে মো. তামিম ও ইয়াসিন আরাফাতকে আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন।
ওসি বলেন, ঘটনার পর রাতেই বাদী হয়ে নিহতের বোন জামাই একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। গতকাল রাত ও আজ সকালের অভিযানে মাহমুদুল হাসান, শান্ত ও শাকিল নমে তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি বলেন, নিহত তাজিন ও বন্ধুদের সঙ্গে মাহমুদুল হাসান, শান্ত ও শাকিলদের সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব চলছিল। নিহত তাজিন জুনিয়র। এর আগেও এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে। গতকাল পরিকল্পনা করেই তাজিনদের ওপর অতর্কিত হামলা করা হয়।
জেইউ/ওএফ