ফের আন্দোলনে যাচ্ছেন সরকারি কর্মচারীরা
- ১২ মে রাজধানীর শহীদ মিনারে মহা-সমাবেশের ডাক
- নতুন পে-স্কেল নয়, বাড়বে চিকিৎসা, শিক্ষা ও টিফিন ভাতা
২০১৫ সালে পে-স্কেল দেওয়ার পর আট বছরে নতুন কোনো পে-স্কেল দেওয়া হয়নি। এছাড়া মহার্ঘ ভাতা বা অন্যান্য কোনো সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয়নি। এদিকে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে ক্ষেত্রবিশেষে ১৫০ শতাংশ। ৫ শতাংশের মুদ্রাস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ অবস্থায় নতুন পে-স্কেল, ৫০ শতাংশ মহার্ঘভাতাসহ সাত দফা দাবিতে ফের আন্দোলনে নামছেন সরকারি কর্মচারীরা। আগামী ১২ মে রাজধানীর শহীদ মিনারে মহা-সমাবেশের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদ।
এদিকে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে নতুন পে-স্কেল দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। একই সুরে কথা বলছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, সরকারের নতুন পে-স্কেল দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা ভাতা, টিফিন ভাতা গ্রেড অনুসারে বাড়তে পারে।
সরকারি কর্মচারীরা বলেন, ৮ম পে-স্কেলে প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি পায়। এ পে-স্কেলে বলা ছিল, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে বেতন-ভাতা সমন্বয় করে বৃদ্ধি করা হবে। কিন্তু গত আট বছরে বাজারে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলেও বেতন বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের ঘরেই রয়েছে। ২০১৫ সালে ৫ শতাংশের মুদ্রাস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। এরপরও ৫ শতাংশ হারেই বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
কর্মচারীরা বলেন, প্রতি বছর যে হারে মূল্যস্ফীতি বা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় সেই হারে বেতন বৃদ্ধি হয়নি। তাই দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে বেতন-ভাতাদি এখন সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর দ্রব্যমূল্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই পে-স্কেল জারি হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ১১-২০ গ্রেডভুক্ত কর্মচারীরা মাস চালাতে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। সংসার, ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা চালাতে কেউ কেউ ঋণের পথ বেছে নিচ্ছেন। যাদের সামান্য সঞ্চয় ছিল, ইতোমধ্যে তাও খরচ করা শুরু করে দিয়েছেন।
১১ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা বলেন, ৯ম পে-স্কেল, ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতাসহ সাত দফা দাবিতে ফের আন্দোলনে নামতে বাধ্য হচ্ছি। আসন্ন বাজেটকে ‘নির্বাচনী বাজেট’ ধরে দাবি আদায়ের মোক্ষম সময় বলে মনে করছেন তারা। এ সময়ের মধ্যে সরকারকে চাপে রেখে দাবি আদায় করতে চান সরকারি কর্মচারীরা। এজন্য আগামী ১২ মে রাজধানীর শহীদ মিনারে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদ।
দাবি আদায় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদের নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর একই দাবিতে জুন মাসে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিলাম। তখন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের আশ্বাসে তা বাতিল করি। কিন্তু এক বছরে একটি দাবিও মানা হয়নি। এমনকি প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক দিনও আমাদের ডাকা হয়নি। এরপর প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিবকে একাধিকবার স্মারকলিপি দিলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এখন আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। বাধ্য হয়ে আবার আন্দোলনের ডাক দিয়েছি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, নতুন পে-স্কেল দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা ভাতা, টিফিন ভাতা গ্রেড অনুসারে বাড়তে পারে। এ মুহূর্তে এর চেয়ে অন্য কোনো চিন্তা আপাতত নেই। সরকারের ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক সংকটের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি আমরা অবগত। কিন্তু অধিকাংশ দাবি-দাওয়াই অর্থ সংশ্লিষ্ট। এগুলো পূরণের জন্য সরকারের শীর্ষ মহল ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন। তাই এখানে আমাদের তেমন কিছু করার নেই।
কর্মচারীরা অনুমতি নিয়ে এ সমাবেশ করছে কি না— এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, আমি যত দূর জানি এখনো এ সংক্রান্ত কোনো অনুমতি তারা নেয়নি।
বাড়বে চিকিৎসা, শিক্ষা ও টিফিন ভাতা
চলতি বছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনে সরকারি কর্মচারীদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও টিফিন ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। ডিসিদের এ প্রস্তাব আমলে নিয়ে এ তিনটি ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি জানান, গ্রেড অনুযায়ী চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা, শিক্ষা ভাতা এক সন্তানদের জন্য ৫০০ টাকা এবং দুই সন্তানের জন্য এক হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়ে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা, টিফিন ভাতা গ্রেড অনুসারে ২০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হতে পারে।
কর্মচারীদের সাত দফা দাবি
বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে সাত দফা দাবিতে প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিবকে একাধিকবার স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে অন্যতম দাবি বর্তমান পে কমিশন পুনর্গঠন এবং ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা প্রদান। তাদের দাবির মধ্যে আরও আছে, ১৯৭৩ সালের ঘোষণা অনুযায়ী ১০ ধাপে বেতন-ভাতা নির্ধারণ, পে-কমিশনে কর্মচারী প্রতিনিধি রাখা, সচিবালয়ের ন্যায় সব দপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পদ ও পদবি এক এবং অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়ন, টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড, বেতন জ্যেষ্ঠতা পুনর্বহাল এবং সব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে গ্র্যাচুইটির পরিবর্তে পেনশন প্রবর্তনসহ বিদ্যমান আনুতোষিকের হার ৯০ শতাংশের স্থলে ১০০ শতাংশ নির্ধারণ।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের আপিল বিভাগের রায় বাস্তবায়ন, সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১০ম গ্রেডে উন্নতকরণ, আউট সোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগ বাতিল, ব্লক পোস্টে কর্মরত কর্মচারীসহ সব পদে কর্মরতদের পদোন্নতি বা পাঁচ বছর পরপর উচ্চতর গ্রেড দেওয়া, অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের বিচার বিভাগীয় কর্মচারী হিসেবে গণ্য করা এবং টেকনিক্যাল কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের টেকনিক্যাল পদমর্যাদা দেওয়া এবং চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর এবং অবসরের বয়সসীমা ৬২ বছর নির্ধারণ করা।
বৈষম্য কত শতাংশ
বর্তমান পে-স্কেলে ১০তম থেকে ১ম গ্রেডের কর্মকর্তাদের জন্য ১২ হাজার ৫০০ থেকে ৭৮ হাজার টাকা পর্যন্ত শুধুমাত্র মূল বেতনে প্রতি ধাপে প্রায় ২০ দশমিক ৪ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল বেতনের ২০ দশমিক ৪ শতাংশ প্রতি প্রমোশনে বৃদ্ধি পায়। এই গ্রেডে বেতন বৃদ্ধি ২০ শতাংশের অধিক হওয়ায় বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বা যে কোনো প্রকার ফিক্সেশনের তাদের আর্থিক সুবিধা বেশি হয়ে থাকে। ফলে তারা প্রমোশনে অনুপ্রাণিত হন।
কর্মচারীদের জন্য ৮ হাজার ২৫০ থেকে ১২ হাজার পর্যন্ত শুধু মূল বেতনে ১১তম-২০তম গ্রেডে প্রতি ধাপে প্রায় গড়ে ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি প্রমোশনে এটি বৃদ্ধি পায়। এই গ্রেডে বেতন বৃদ্ধি ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ অধিক হওয়ায় বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বা যে কোনো প্রকার ফিক্সেশনের তাদের আর্থিক সুবিধা খুবই নগণ্য ফলে তারা প্রমোশনে অনুপ্রাণিত হন না বরং বদলিজনিত বিড়ম্বনায় পড়েন।
আলোচনায় মহার্ঘ ভাতা
দেশের টালমাটাল অর্থনীতির মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন পে-স্কেল দেওয়া সম্ভব না বলে সাফ জানিয়েছে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কারণে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার আলোচনা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আগামী বাজেটে দ্রব্যমূল্য সমন্বয়ের জন্য ১০ থেকে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার চিন্তা চলছে। বাজেট চূড়ান্ত হওয়ার পর মহার্ঘ ভাতা নিয়ে আলাদা একটা ফাইল সরকারের শীর্ষ মহলে পাঠানো হবে। সেখানে সায় মিললে বাজেটে কর্মচারীদের জন্য ‘নির্বাচনী উপহার’ ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী।
মহার্ঘ ভাতায় কত টাকা বেতন বাড়বে
লম্বা সময় নতুন কোনো পে-স্কেল না দেওয়া এবং দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে বর্তমান সরকার সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দিয়েছিল। ওই সময় সর্বনিম্ন ১৫০০ টাকা থেকে সবোর্চ্চ ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন বেড়েছিল।
এরপর ২০১৫ সালে ৮ম পে-স্কেল দেওয়ার পর আর কোনো মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয়নি। আর্থিক সংকটে থাকা সরকারের পক্ষে যেহেতু নতুন পে-স্কেল দেওয়া সম্ভব নয়, তাই চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে বিবেচনায় নিয়ে আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব তুলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, মহার্ঘ ভাতায় বাড়ি ভাড়া বাড়ে না। এক্ষেত্রে নির্ধারিত সিলিং তৈরি করে শুধু মূল বেতন বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত চাকরিজীবীদের মূল বেতনের ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করা হবে। যদি ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায় তবে আট হাজার ২৫০ টাকার ২০ শতাংশ হিসেবে একজন কর্মচারীর বেতন বাড়বে এক হাজার ৬৫০ টাকা। এ ক্ষেত্রে মাসিক সর্বনিম্ন এক হাজার ৭০০ থেকে দুই হাজার টাকা মূল বেতন বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভাবনা রয়েছে।
সরকারের জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সামরিক বাহিনীর সব সদস্য এ মহার্ঘ ভাতা পাবেন। এছাড়া এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরাও এ ভাতা পাবেন। একইসঙ্গে অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছুটি পূর্বকালীন সর্বশেষ প্রাপ্য মূল বেতনের ভিত্তিতে এ ভাতা পাবেন।
এনএম/এফকে