২৮ বছরেও নেই নাগরিক সুবিধা, পূর্বাচলে বাড়ি বানাচ্ছে না কেউ
৬ হাজার ১৫০ একর জায়গা নিয়ে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। তখন বলা হয়েছিল, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে প্রকল্পের কাজ। ৩০টি সেক্টরে সেখানে ২৬ হাজার প্লটে আবাসিক ভবন গড়ে ওঠার কথা ছিল। এরই মধ্যে ২১ হাজার প্লট হস্তান্তরও করা হয়েছে। তবে ভবন নির্মাণের কাজ হয়েছে বা চলছে মাত্র ৩ শর মতো প্লটে। প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৫ বার নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। ৭ বার বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ করা হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। রাজউকের দাবি, প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৭০ শতাংশ।
ঢাকার পাশে নতুন এই শহরের প্রকল্প এলাকায় প্লট পাওয়া বেশিরভাগ মানুষই এখনো সেখানে বাড়ি বানানোর চিন্তা করছেন না। কারণ, তাদের মতে সেখানে বাড়ি করার উপযোগী পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বেশিরভাগ প্লটগ্রহীতার অভিযোগ, ন্যূনতম কোনো নাগরিক সুবিধাই সেখানে নিশ্চিত করেনি রাজউক। কবে সেখানে বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি হবে, কবে নিজের বাড়িতে থাকতে পারবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন প্লট মালিকরা।
প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পড়ে আছে হাজার হাজার ফাঁকা প্লট। বহুদূর পরপর দু-একটি প্লটে দাঁড়িয়ে আছে অপ্রস্তুত-আধা প্রস্তুত বাড়ি। কোনো কোনো প্লটে গড়ে উঠেছে টিন-কাঠের অস্থায়ী ঘর। বড় বড় অনেক প্লটে গজিয়েছে ঝোঁপ-ঝাড়। কিছু প্লটে চাষাবাদ হচ্ছে নানা রকম শাক-সবজি। খুবই অল্পকিছু বাড়ি পুরিপূর্ণভাবে নির্মিত হয়েছে এবং সেখানে, নানা সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই, মানুষ বসবাস করছে। প্রকল্প এলাকায় এখনো পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়নি। রাস্তাঘাটও তেমন গড়ে ওঠেনি। রাস্তায় কোনো বাতি নেই। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে সেখানে কোনো থানা বা পুলিশ ফাঁড়িও নেই।
আরও পড়ুন : সাধারণের নাগালের বাইরে ফ্ল্যাটের দাম
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পূর্বাচলে প্লট নেওয়া অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, সারা জীবন ভাড়া বাসায় থেকেছি। ইচ্ছা ছিল অবসর গ্রহণের পর নিজের একটি বাড়ি বানাব। সেই লক্ষ্যে পূর্বাচলের ১৬ নম্বর সেক্টরে একটি প্লট কিনেছিলাম। কিন্তু এখনও সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি। নেই গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সুবিধা। সব মিলিয়ে কেউ সেখানে বাস করার জন্য বাড়ি নির্মাণে আগ্রহী হচ্ছে না। আমিও প্লট কিনে বহু বছর ফেলে রেখেছি। শুধু আমি নই, পূর্বাচলজুড়ে হাজার হাজার প্লটের মালিক বাড়ির কাজ শুরু করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, প্লট মালিকরা দ্বিধায় আছেন কাজ শুরু করা নিয়ে। এর দোষ সম্পূর্ণরূপে রাজউকের, তারা সেখানে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারছে না। এটা তাদের ব্যর্থতা। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের মতো প্লট গ্রহীতাদের।
একটি প্লটের নিরাপত্তা প্রহরী এরশাদ আলী বলেন, এখানে কোনো সড়কে বাতি নেই। রাতে পুরো এলাকা নিস্তব্ধ থাকে। এ প্লটের মালিকের বাসা নিকেতনে, তিনি পূর্বাচলে জমি নিয়েছেন অনেক বছর আগে। কিন্তু এখনও বিল্ডিং করার কাজ শুরু করেননি। আশপাশের কেউই শুরু করেনি কাজ, সে কারণে পূর্বাচলের সব এলাকা এখনও নিস্তব্ধ। বিদ্যুৎ আর পানির সংযোগ এখানে ভালোভাবে আসলে আমার স্যার বাড়ির কাজ শুরু করবেন। এর আগ পর্যন্ত প্লট দেখাশোনার দায়িত্বে আমি আছি।
আরও পড়ুন : মেট্রো স্টেশন ঘিরে নতুন বাড়ি নির্মাণ, বেড়েছে ভাড়া
জানা গেছে, পূর্বাচলে প্লটগুলোতে ভবন নির্মাণ শুরু হলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেবে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। বর্তমানে যে কয়টি জায়গায় বসতি আছে সেখানে কিছু কিছু বিদ্যুতের সংযোগ দিচ্ছে সংস্থাটি।
অন্যদিকে পানির জন্য এখনও কাজ শুরুই করেনি ঢাকা ওয়াসা। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, পূর্বাচল নতুন শহর যেহেতু রাজউকের একটি বাণিজ্যিক প্রকল্প তাই রাজউক নিজের উদ্যোগেই সেখানে পানির লাইনের ব্যবস্থা করবে।
আর সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে যদি সরকার নতুন করে প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগ আবাসিক ভবনে দেয়, তাহলে পূর্বাচল গ্যাস সংযোগ পাবে। নাহলে সেখানে আবাসিক ভবনে গ্যাস সংযোগ পাওয়া যাবে না।
সব মিলিয়ে যারা পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন তারা এখন বেশ দোলাচলে আছেন। সে কারণে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও সেখানে ভবন নির্মাণ করছেন না তারা। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত হতে শুরু করলে তখন হয়ত প্লট মালিকরা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করবেন।
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চারটি থানা স্থাপন করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জমি দিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখনো সেখানে কোনো থানা স্থাপন রা হয়নি। থানাগুলো স্থাপন করা হলে প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পড়ে আছে হাজার হাজার ফাঁকা প্লট। বহুদূর পরপর দু-একটি প্লটে দাঁড়িয়ে আছে অপ্রস্তুত-আধা প্রস্তুত বাড়ি। কোনো কোনো প্লটে গড়ে উঠেছে টিন-কাঠের অস্থায়ী ঘর। বড় বড় অনেক প্লটে গজিয়েছে ঝোঁপ-ঝাড়। কিছু প্লটে চাষাবাদ হচ্ছে নানা রকম শাক-সবজি
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, পূর্বাচলে এখনও সেভাবে বসতি গড়ে ওঠেনি। খুব বেশি নকশার অনুমোদনও হয়নি। আশা করা যায়, শিগগিরই নকশার অনুমোদনের আবেদন শুরু হবে। পূর্বাচলে এমআরটি লাইনের কাজ শুরু হয়েছে, এরপর এর সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগের আলাদা মাত্রা যোগ হবে। এখনও কার্যকরী নানা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া সম্ভব। নাগরিক সুবিধা যেন দ্রুত নিশ্চিত করা যায় সেদিকে খেয়াল রেখে কাজ করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন : ঢাকায় এক কবর দেড় কোটি টাকা
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার সমালোচনা করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পূর্বাচল প্রকল্পের কাজ সর্বোচ্চ ১০ বছরের মধ্যে শেষ করা উচিত ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও প্রকল্পের কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। এটা খুবই দুঃখজনক। নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে না পারলে প্লট গ্রহীতারা বাড়ি বানাবেন না এটাই স্বাভাবিক। নিজেদের সক্ষমতা আগেই বিশ্লেষণ করা উচিত ছিল রাজউকের।
তিনি বলেন, বারবার প্রকল্পের নকশার পরিবর্তন করা হচ্ছে। আগে যেসব উন্নয়নের কাজ করা হয়েছিল সেগুলো নষ্ট হয়েছে বা হচ্ছে। অন্যদিকে পূর্বাচলের আশপাশে যেসব বেসরকারি আবাসন কোম্পানি কাজ করছে তারা এগিয়ে যাচ্ছে।
এএসএস/এসকেডি