চোখ ভিজে যায়, মন বিষিয়ে ওঠে, তবুও খবর নেয় না স্বজনরা
শেরপুর নকলার চকপাড়া কাটা গ্রামের গেরস্ত ছিলেন দেলোয়ার হোসেন। ১৫ বিঘার উপরে জমি ছিল তার। একে একে জন্ম দেন পাঁচ সন্তান। কিন্তু নানা জটিলতায়, অসুস্থতায় মারা যায় চার সন্তান। তাদের বাঁচাতে নিঃস্ব-অসুস্থ হয়ে পড়লে এক মাত্র জীবিত সন্তান রাজ্জাকের ঘরে ঠাঁই মেলেনি বাবা দেলোয়ারের।
দীর্ঘ ২০ বছর ঢাকায় রিকশা চালিয়ে সংসারের ঘানি টেনেছেন। অসুস্থ অবস্থায় পড়েছিলেন তেজগাঁওয়ের লোকাস মোড়ে। খবর পেয়েও বাবাকে ঠাঁই দেয়নি সন্তান। পরে লোক মারফত খবর পেয়ে বৃদ্ধ দেলোয়ারের ঠাঁই মেলে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ বৃদ্ধাশ্রমে।
নাতি-নাতনিদের মুখ দেখতে আকুল দেলোয়ারে সঙ্গে দেখা তো দূরের কথা ফোনেও কথা বলেন না ছেলে রাজ্জাক। পরিবার, স্ত্রী সন্তান, নাতি-নাতনী ছাড়া অচেনা অজানা বৃদ্ধাশ্রমেই জীবনের প্রথম ঈদ কাটছে দেলোয়ারের।
আরও পড়ুন>>এক প্যাকেট খাবার ঘিরেই ওদের ঈদ
শনিবার (২২ এপ্রিল) সন্ধ্যায় রাজধানীর কল্যাণপুর পাইকপাড়ায় (বাড়ি-৪৬২, সড়ক-৮ দক্ষিণ পাইকপাড়া) ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ বৃদ্ধাশ্রমে কথা হয় বৃদ্ধ দেলোয়ারের সঙ্গে।
আবেগ উগড়ে দিয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গেরস্ত ছিলাম। জমি-জমা অনেক ছিল। কিন্তু সন্তানদের জন্য নিঃস্ব হয়েছি। সব হারিয়ে ঢাকায় আসছি। দীর্ঘ সময় নিজেই উপার্জন করেছি। অসুস্থ হয়ে পড়লেও বাসায় জায়গা দেয়নি ছেলে। রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে হাত ঠেলা গাড়িতে ঘুরেছি, ভিক্ষা করেছি। একটা সময় বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে ফুটপাতেই পড়ে থাকতাম। পরিচিত লোক মারফত ছেলেকে খবর দিতাম, ছেলে আসত না। আজ আমি এখানে।
বৃদ্ধ দেলোয়ার বলেন, জীবনের প্রথম ঈদ বৃদ্ধাশ্রমে। অথচ জীবনে কী ছিল না আমার! ভীষণ খারাপ লাগছে। সারাদিন অপেক্ষায় ছিলাম, এই বুঝি ছেলে আসবে দেখতে নাতি-নাতনিদের নিয়ে। আসেনি।
‘অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে সন্ধ্যায় ফোন করি ছেলেকে। ফোন ধরেনি। খুব মন চাইছিল একবার ছেলেডারে দেখমু, নাতি-নাতনিদের কোলে নিমু। হলো না।’
আরও পড়ুন>>নগরবাসীর ঈদ আনন্দে স্বস্তি খুঁজে পান তারা
বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার বলেন, পরিবার ভিন্ন এক অনুভূতি। সেটা যারা হারিয়েছেন তারাই বোঝেন ব্যথা। ৭৩ বছর বয়সী দেলোয়ারই নয় শুধু, ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছেন ১৩৫ বৃদ্ধ বাবা-মা। যাদের অধিকাংশরাই সম্ভ্রান্ত পরিবারের। কেউ পেশাগত জীবনে বুয়েটের শিক্ষক ছিলেন, কেউ ইঞ্জিনিয়ার কেউবা বেরসকারি অফিসের বড় কর্মকর্তা। কিন্তু জীবনের অসহায় মুহূর্তে পরিবার থেকে এক রকম বিতাড়িত তারা। বৃদ্ধাশ্রমটিতে রয়েছে পিতৃ পরিচয়হীন ৩৫ শিশুও।
ঈদ মানে আনন্দ হলেও বৃদ্ধাশ্রমে ঈদ মানে অভিমান আর চাপা কষ্টের। কখনো কখনো কাউকে আমরা গুমরে কাঁদতে দেখি। তখন বিষাদ নেমে আসে, কষ্টে ছেয়ে যায় পুরো বৃদ্ধাশ্রম। নতুন লুঙ্গি, ফতুয়া, কাপড়, গেঞ্জি-প্যান্ট, সুস্বাদু ও ভালো খাবারেও কাটে না সে বিষাদ।
‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ বৃদ্ধাশ্রমে কথা হয় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন আরেক বৃদ্ধ বাবা আব্দুর রশিদ মাস্টারের সঙ্গে।
আরও পড়ুন>>ভোগান্তি ছাড়াই জীবন্ত প্রাণী দেখলেন লাখো দর্শনার্থী
বৃদ্ধাশ্রম সূত্রে জানা যায়, তার বাড়ি বগুড়া নন্দিগ্রামের ভাটগ্রামে। বগুড়ায় যাত্রী ছাউনিতে দিনের পর দিন পড়েছিলেন তিনি। চার মাস এখানে চারটি হাইস্কুলের হেড মাস্টার হিসেবে পেশাগত জীবন পার করা আব্দুর রশিদকে জায়গা দেন মিল্টন সমাদ্দার। পুরো বৃদ্ধাশ্রমের সবাই তাকে স্যার বলেই সম্বোধন করেন।
আব্দুর রশিদ বলেন, আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেটা মারা গেছে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। স্বজন-আত্মীয়রা কেউ খবর নেয় না। ভাবছিলাম মেয়েটা অন্তত আজকের দিনে খবর নেবে! নেয়নি। দুঃখ হয় কষ্ট হয়। চোখ ভিজে যায়। কিন্তু এ ব্যথা নিয়েই এখানে থাকা। আমার পরিবার এখন এই বৃদ্ধাশ্রমই।
এক সময়ের প্রভাবশালী ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী টিপুর জায়গাও আজ এ বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা পাওয়ার পর থেকেই নিজেকে নিঃসন্তান বলে দাবি করে আসছেন এয়ারটেলের সাবেক ইঞ্জিনিয়ার টিপু।
আরও পড়ুন>>পার্কে শিশুদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস
টিপু বলেন, আমার কেউ নেই। থাকলেও কেউ খবর নেয় না। আমিও নেব সে অবস্থা নেই।
অভিমানের সুরে বলেন, আমি নিঃসন্তান, স্ত্রীও মারা গেছেন, স্বজন বলে কেউ নেই। এটাই আমার পরিবার, এটাই আমার ঘর।
‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ কর্মীরা জানান, এখানে এমন অনেক বাবা-মা আছেন যারা নিজেরাও অভিমান ভুলে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। পরিবার-স্বজনও খবর নেয় না। চাপা কষ্ট পুষে অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন।
মানবসেবায় প্রায় এক দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছেন এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক বাবা-মা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ বিতাড়িত হয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিচ্ছেন। পিতৃপরিচয়হীন অনেক শিশু বেড়ে উঠছে সড়কেই। আমার লক্ষ্য এই বাবা-মা’ কিংবা পরিচয়হীন শিশুদের পরিচয় দেওয়া, আশ্রয় দেওয়া। তাদের জন্য কিছু করা।
আরও পড়ুন>>হাতিরঝিলে ঈদ আনন্দ
তিনি বলেন, অনেক সন্তান জানেন তাদের বাবা মা এখানে আছে। কিন্তু ঈদ আসে ঈদ যায়, খোঁজও নেন না, ঈদের দিনেও আসেন না এখানে থাকা বৃদ্ধ বাবা-মা’কে দেখতে। ঈদের দিন যত ভালো খাবারই দিই না কেন, চাপা কষ্ট উগড়ে কেউ কেউ ভেঙে পড়েন কান্নায়।
মিল্টন বলেন, আমাদের নিজস্ব ফান্ড নেই। শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায় চলে এই বৃদ্ধাশ্রম। প্রতি মাসে এই ১৭০ জন মানুষের পেছনে খরচা হয় প্রতি মাসে ২৮-৩০ লাখ টাকা। বিত্তশালীদের আহ্বান জানাই ১০টা টাকা এখানে দেন, অন্তত একটা ইট কিনে দেন স্থায়ী আবাসের জন্য। জীবনের শেষ সময়টা যেন পরিবার বিচ্ছিন্ন, এই বৃদ্ধ অসহায় বাবা-মা একটা ভালো থাকেন।
জেইউ/এসকেডি