পদ্মা সেতুতে হঠাৎ মোটরসাইকেল : নেপথ্যে কী?
পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দিয়েছে সরকার। এর ফলে ২০ এপ্রিল থেকে কিছু নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট লেনে সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিতে মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে পুনরায় মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি বাতিল হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন।
পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল প্রসঙ্গে মার্চ মাসে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলছিলেন, শান্তিতে আছে পদ্মা সেতু।
কিন্তু এক মাসের ব্যবধানে হঠাৎ কেন এ সিদ্ধান্ত?
এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, মূলত দুটি কারণে এ অনুমতি দিয়েছে সরকার। প্রথমটি রাজস্ব দ্বিতীয়টি ঈদ যাত্রায় ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নির্বিঘ্ন করা।
হঠাৎ কেন মোটরসাইকেল চলাচলে অনুমতি দেওয়া হলো, জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী এ অনুমতি দিয়েছেন। মোটরসাইকেল আরোহীদের দাবি এবং ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতেই এই অনুমতি।
তিনি বলেন, সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পদ্মা সেতু পার হতে গিয়ে মোটরসাইকেল চালক বা আরোহীরা যদি শর্তাবলি ভঙ্গ করেন তবে ফের চলাচলের অনুমতি বাতিল করা হবে। পদ্মা সেতু জাতীয় সম্পদ এটার রক্ষাণবেক্ষণ ও সৌন্দর্য রক্ষা আমাদের সবার দায়িত্ব। কিন্তু মোটরসাইকেল চলাচল করতে গিয়ে মাঝখানে সেলফি তুলতে রেলিংয়ে দাঁড়ানো বা যেকোন ধরনের বিশৃঙ্খলা করলে ফের অনুমতি বাতিল করা হবে।
পদ্মা সেতুতে হঠাৎ কেন মোটরসাইকেলের অনুমতি?
গত বছর ২৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার পর পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। আর প্রথম দিনেই সেখানে ঢল নামে মোটরবাইক আরোহীদের। তারা সেতুর উপর উঠে দল বেঁধে আনন্দ-উল্লাস আর হৈ-হুল্লোড়ে মাতেন। সেই রাতে বাইক দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হলে ২৭ জুন ভোর থেকে পদ্মা সেতুতে মোটর সাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করে সেতু বিভাগ।
পরবর্তীতে কয়েক দফা সময় দিয়েও মোটরসাইকেল আরোহীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি এ সেতু। বাইকাররা কয়েক দফা দাবি জানালেও মিলেনি সুফল। তবে ঈদকে সামনে রেখে কিছু শর্তের মধ্য দিয়ে নতুন করে সেতুতে মোটর সাইকেল চলাচলের অনুমতি মিলেছে। এক কথায় পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চালানোর স্বপ্ন পূরণ হতে অপেক্ষা করতে হল দশ মাস।
হঠাৎ করে ''শান্তিতে থাকা'' পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি কেন দেওয়া হলো, জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চালকরা দাবি জানিয়ে আসছিল। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসব দাবি উত্থাপন করলে তিনি সব দিক বিবেচনা করে এ অনুমতি দিয়েছে।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তা বলছেন, ঈদকে সামনে রেখে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অন্যতম কারণ এবারের ঈদযাত্রা আরও নির্বিঘ্ন করা। মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতির দেওয়ার পর শিমুলিয়া ঘাট থেকে মোটরসাইকেল পারাপারের জন্য সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা পরপর ফেরি ছাড়বে। আরোহীসহ বাইক প্রতি ভাড়া ১৫০ টাকা। আর এবার পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি মিলেছে। সব মিলিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের প্রচুর মানুষ মোটরসাইকেলে বাড়ি যাবে। এতে বাস, লঞ্চের ওপর চাপ কমবে। ভাড়ার নৈরাজ্য কমবে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সেতু বিভাগের সচিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজস্ব তো একটি বিষয় বটেও। তার চেয়ে বড় বিষয় মোটরসাইকেল আরোহীসহ বিভিন্ন মহলের দাবি। এসব দাবি মেনেই এ অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোটরসাইকেল চললে সরকার ১’শ টাকা টোল পাবে। বন্ধ থাকায় সরকার এ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। আমার ধারণা অনুমতির পর প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ হাজার মোটরসাইকেল পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে যাতায়াত করবে। এতে বড় অঙ্কের রাজস্ব পাবে সরকার।
তবে হঠাৎ করে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়ার টেকনিক্যাল বিষয়গুলো সরকারকে ব্যাখ্যা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
নেপথ্যে রাজস্ব আদায়
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি না থাকায় সরকার প্রচুর রাজস্ব হারাচ্ছে। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। গত ৫ এপ্রিল প্রথম কিস্তির ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার ৪৯ টাকার একটি চেক গ্রহণ করেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। আগামী জুনে দ্বিতীয় কিস্তি পরিশোধ করবে বলে জানিয়েছেন সড়ক, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সেতু বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কিস্তি পরিশোধের জন্য সেতু বিভাগ রাজস্ব আদায়ে জোর দিচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি চেয়েও সরকারের শীর্ষ মহল থেকে সাড়া মিলেনি। এবার রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি সরকার প্রধানকে সঠিকভাবে বুঝানোর পর তিনি সায় দিয়েছেন।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু একটি মোটরসাইকেল ওয়ান ওয়ে (একবার যাতায়াত) একশ টাকা টোল দিতে হবে। অর্থাৎ একটি মোটরসাইকেল একবার গেলে দ্বিতীয়বার সে ফেরত আসবে। সব মিলিয়ে দুই’শ টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
অনুমতি দেওয়ার পিছনে রাজস্ব একটা মুখ্য ভূমিকা রেখেছে বলেও উল্লেখ করছেন সেতু বিভাগের এই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেলের অনুমতি দেওয়ার ফলে রাজধানীর ৫ থেকে ৬ লাখ বাইকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাবেন। ফলে ঈদযাত্রায় গণপরিবহনের প্রবল চাপ কমবে। ভাড়া নৈরাজ্য কমবে। আর পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়ায় এ চাপ আরো বহুলাংশে কমে আসবে।
মোজাম্মেল হক বলেন, সরকারের এ অনুমতিতে পরিবহন মালিক ও বাইকারদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। সরকার নির্দিষ্ট গতি ও আইন মেনে চলার জন্য বলেছে। তাদের উচিত এসব আইন মেনে চলা। একইসঙ্গে মোটরসাইকেলে ব্যক্তিগত পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রী ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। মোটরসাইকেলে ল্যাগেজ ও পরিবারের সদস্যদের যাতায়াত না করার অনুরোধ করেন তিনি।
তিনি বলেন, অসাবধানতা বা নিরাপত্তা না মানার কারণে পদ্মা সেতুতে আবার যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তবে সেতুতে স্থায়ীভাবে মোটরসাইকেল বন্ধ হয়ে যাবে।
এনএম/এমজে