এই গরমেও পানি নেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়
বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল উষ্ণতম ঋতু হলেও চৈত্র মাসের শুরু থেকেই গরম পড়তে শুরু করে। এবারও চৈত্র মাসেই গরম শুরু হয়েছে স্বাভাবিক নিয়মে, তবে অস্বাভাবিক ধারায়। গত ৫৮ বছরের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ গরম পড়েছে ঢাকায়।
অতিমাত্রার দাবদাহে জনজীবনে নাভিশ্বাস অবস্থা। এর মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ওয়াসার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে এই সময়ে তীব্র সমস্যায় পড়েছে ওই সব এলাকার বাসিন্দারা।
যদিও চাহিদার তুলনায় পানি উৎপাদনের সক্ষমতা বেশি বলে দাবি করছে ঢাকা ওয়াসা। তবুও কেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর আদাবর, শেখেরটেক, রায়ের বাজার, মেহেদীবাগ, মোহাম্মাদিয়া হাউজিং, মান্ডা, কুসুমবাগ এলাকার কিছু কিছু অংশে পানির সংকট তীব্রভাবে দেখা দিয়েছে।
এসব এলাকায় পানির সমস্যা নিয়মিত হলেও রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ভাষানটেক, মাটিকাটা, উত্তরা, আফতাবনগর, বাড্ডা, ভাটারাসহ বেশ কিছু এলাকায় মাঝে মধ্যেই পানির সংকট দেখা দিচ্ছে।
রাজধানীর আদাবর এলাকার বাসিন্দা জিনাত আরা নীলা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আদাবর এলাকায় পানির সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, এত তীব্র গরম, সবার পানির ব্যবহার বেড়ে গেছে, এইদিকে চলছে রমজান মাস। তবুও আমরা পানি পাই না। আমাদের বাসাসহ আশপাশের বাসায় ঠিক মতো পানি আসে না। যে কারণে আমাদের এলাকার বাসিন্দাদের খুব কষ্ট করে চলতে হচ্ছে এই রমজানে। দূর থেকে পানি আনতে হয় মানুষ দিয়ে। নিজেরা গভীর রাতে অল্প কিছু সময়ের জন্য পানি পাই কিন্তু সারাদিন পানি থাকে না আমাদের। বারবার ওয়াসার কাছে আমরা এলাকাবাসী অভিযোগ জানিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। শুধু তারা বলে যাচ্ছে, ঠিক হয়ে যাবে। একটা বাসায় যদি পানি না থাকে তাহলে তাদের কেমন কষ্ট এটা বোঝানো যাবে না। পানি ছাড়া জীবন অচল কিন্তু সেই পানি আমরা দীর্ঘ দিন ধরেই পাচ্ছি না ঠিকমতো। রমজান মাসেও আমাদের পানির সংকট।
• আরও পড়ুন : ঢামেকে তীব্র গরমে রোগীদের হাঁসফাঁস, গায়ে লাগে না ফ্যানের বাতাস
শেখেরটেক এলাকার আরেক বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের পানির সমস্যার কোনো সমধান দিতে পারছে না ওয়াসা। পানির কষ্টের মধ্যেই আমাদের জীবন চলছে। এই তীব্র গরমে বাইরে থেকে আসার পর গোসল করতে পারি না, রমজান মাসে পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ পাই না। মাঝে মাঝে পানি আসে সেখানেও অনেক সময় দুর্গন্ধ থাকে পানিতে। ওয়াসার গাড়িকে পানি আনতে বলা হলেও তারা সবসময় আসে না। নিজেদের সুবিধা মতো সময়ে আসে ফলে পানির দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের মতো সাধারণ বাসিন্দাদের। লোক নিয়ে দূর দূরান্ত থেকে পানি আনতে হয় আমাদের।
একই এলাকার একটি বাড়ির মালিক খালেকুজ্জামান বলেন, বারবার অভিযোগ জানিয়েছি ওয়াসার কাছে। কিন্তু কোনো সমাধান পাইনি এখনও। আমাদের এই এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে এমন সমস্যা। ফলে ভাড়াটিয়া থাকে না এই এলাকার বাসাগুলোতে। রমজান মাস চলছে তবুও পানির সামাধান দিতে পারেনি ওয়াসা। একটি বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ না থাকে তাহলে কিভাবে আমরা বসবাস করব? এই তীব্র গরমে সারাদিনে যদি পানি না পাওয়া যায় তাহলে কেমন কষ্টে মানুষের দিন চলে এটা উপলব্ধি করার মতো কেউ কি নেই ওয়াসায়? তবে রাতের বেলায় মাঝে মাঝে পানি পাওয়া যায় তবে সেটা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়।
এদিকে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার কুমিল্লা পাড়ায় হঠাৎ পানির সংকট দেখা দিয়েছিল গত দুই দিন আগে। এসময় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে ওয়াসার ফোন নম্বরে কল করে পানির গাড়ি চাওয়া হয়। এই বিষয়ে ওই এলাকার এক বাড়ির কেয়ারটেকের চাঁদ মিয়া বলেন, এক গাড়ির পানির দাম ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। কিন্তু তারা আসার পর পানি দিতে ১০০০/১২০০ টাকা দাবি করে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী অতিরিক্ত টাকা দিয়েই পানি নিতে হয় নিয়মিত। অতিরিক্ত টাকা না দিলে পরের বার তারা আর আসে না। এই গরমের সময়ে প্রায় প্রায় পানির সংকট দেখা দেয় আমাদের এলাকায়। কিন্তু যখনই পানির গাড়ি নিয়ে আসে তখনই তারা অতিরিক্ত টাকা নেয় সব সময়।
এদিকে ঢাকা ওয়াসার দাবি চাহিদার তুলনায় বেশি পানি উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে তাদের। অন্যান্য সময় বা শীতকালে রাজধানীতে দৈনিক পানির চাহিদা থাকে ২১০ কোটি লিটার থেকে কখন কখনও ২৩০/২৪০ কোটি লিটারের। কিন্তু গরমকাল এলে এটা বেড়ে ২৬০ লিটারে গিয়ে দাঁড়ায়। তবে বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার প্রতিদিন প্রায় ২৯০ কোটি লিটার পানির উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন এখন গড়ে ২৬০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করছে ঢাকা ওয়াসা।
তবুও কেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানির এমন সংকট, সমস্যা? সে বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, আদাবর, শেখেরটেক এলাকাসহ বেশ কিছু এলাকায় ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহের কিছুটা সমস্যা আছে। এই সমস্যা সমাধানে ওই এলাকাসহ আশেপাশের এলাকায় আমরা নতুন করে পাম্প বসাচ্ছি। এরপর থেকে ওই এলাকার পানির সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এছাড়া পাইপ লাইনের কাজ করা হবে সেখানে, এরজন্য সিটি করপোরেশনের কাছে রাস্তা কাটার অনুমতি আমরা চেয়েছি। সার্বিকভাবে ওয়াসার পানি সরবরাহের কোনো সমস্যা নেই, ঘাটতি নেই। তবে রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় স্থানীয়ভাবে কিছু কিছু এলাকায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি, এর সমাধানে আমাদের কাজ চলছে। আশা করা যায় খুব দ্রুতই এমন সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এছাড়া ওয়াসার পানির গাড়িতে যারা বেশি টাকা দাবি করছে, এ বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ জানালে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
• আরও পড়ুন : ‘মনে হচ্ছে শরীর পুড়ে যাচ্ছে’
সম্প্রতি পানি সরবরাহ বিষয়ে নিজেদের এক সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়ে ঢাকা পোস্টের এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেন, আমাদের উৎপাদনের ক্যাপাসিটি প্রতিদিন ২৯০ কোটি লিটারে চলে গেছে। কিন্তু পানি সরবরাহে এলাকাভিত্তিক কিছু সমস্যার অভিযোগের কথা যেটা বলছেন। এর কারণ অনেক সময় বিভিন্ন এলাকায় যখন একটি পাম্প নষ্ট হয়ে যায়, তখন সেটি ঠিক করতে ২০ থেকে ৪৫ দিন সময় লেগে যায়। তখন সাময়িক সমস্যা হয় শুধুমাত্র ওই নির্দিষ্ট পাম্পের আওতাধীন এলাকায়। তবে ডিমান্ড এবং সাপ্লাইয়ের কোনো গ্যাপ আমাদের নেই।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মোট ৮০০টির মতো পাম্প আছে এরমধ্যে ধরলাম কোনো কারণে ৮টি পাম্প নষ্ট অবস্থায় আছে। তখন সেই এলাকায় দেখা যাচ্ছে এক কোটি লিটার পানি সরবরাহের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু পুরো রাজধানীতে আমাদের সাপ্লাই ঠিক থাকে। তখনও কিন্তু আমাদের চাহিদা অনুযায়ী ২৬০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হচ্ছেই। সব মিলিয়ে মাঝে মাঝে রাজধানীর দুই একটি এলাকায় পানির সমস্যা দেখা দেয়। আমরা এটির সমাধান নিয়ে কাজ করছি, আশা করছি খুব দ্রুতই এমন সমস্যা আর থাকবে না।
ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার পানি শোধনাগার রয়েছে ৫টি। তবে সংস্থাটি পানি পাচ্ছে ৪টি শোধনাগার থেকে। চলতি বছরে উপরিতলের পানির উৎপাদন ৭০ শতাংশে উন্নীত করার কথা থাকলেও সেই লক্ষ্যপূরণ এখনও করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা। বর্তমানে উপরিতলের পানি পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৩৫ শতাংশ। আর বাকি ৬৫ শতাংশ ওয়াসার সরবরাহ করাব পানি তারা পাচ্ছে ভূগর্ভস্থ থেকে।
রমজান মাসে পানি সরবরাহ ঠিক রাখতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঢাকা ওয়াসা পবিত্র রমজান মাসে ঢাকা শহরের পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য সকল পানি শোধানাগার ও পানির পাম্পগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে ২৪ ঘণ্টা চালু রেখেছে। বিদ্যুৎ বিভ্ৰাটকালীন লোড-শেডিং, লো-ভোল্টেজ, হাই-ভোল্টেজের সময়ে পানির পাম্পগুলো ডুয়েল সোর্স বিদ্যুৎ লাইন, ফিক্সড জেনারেটর, মোবাইল জেনারেটর দ্বারা চালু রাখা হচ্ছে রমজানে। সবগুলি জোনাল অফিস, এসওসিতে পর্যাপ্ত পানির গাড়ি প্রস্তুত রেখেছে তারা। জরুরি প্রয়োজনে পানি সরবরাহের জন্য ঢাকা ওয়াসায় ৪৮টি পানির গাড়ি এবং ১৭ টি ট্রাক্টর প্রস্তুত থাকছে।
অন্যদিকে গুলিস্তান, ফার্মগেট, মহাখালী, গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর, সায়েদাবাদ বাসষ্ট্যান্ডসহ সকল জোনের বিভিন্ন স্থানে ইফতার ও সেহরির সময় প্লাস্টিক ট্যাংক, ট্রলি স্থাপন করে পানি সরবরাহ করছে তারা।
এছাড়া অভিযোগ প্রাপ্তিসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ‘ওয়াসালিংক-১৬১৬২’ এবং ১১টি অভিযোগ কেন্দ্র ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি মডস জোনের পানির পাম্প মনিটরিং করার জন্য বিদ্যমান ১০টি অ্যাডভাইজরি ও মনিটরিং টিম গঠন করে রেখেছে তারা।
এএসএস/এনএফ