হিরো হতে চাইনি, ব্যবসায়ীদের চোখের পানির মূল্য দিতে চেয়েছি
ভাইরাল বা হিরো হওয়ার জন্য কিছু করিনি। সে রকম কিছু আমার মাথায়ও আসেনি। ব্যবসায়ীদের কান্না আর আহাজারি বুকে বিঁধছিল। নিজের মনুষ্যত্ব নাড়া দিচ্ছিল, মাথায় শুধু কাজ করছিল কিছু একটা করতে হবে। এর মধ্যেই সুযোগ আসে। ঊর্ধ্বতন স্যারদের নির্দেশ পেয়ে অস্ত্র জমা রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ি পুড়তে থাকা ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের মালামাল সরানো এবং আটকে পড়া দোকানিদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনার কাজে।
এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে লাগা আগুনের ঘটনায় জীবন বাজি রেখে উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া পুলিশ কনস্টেবল পরান সরকার। আগুনের ঘটনায় অনেকে উদ্ধার কাজে অংশ নিলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরান সরকারের মানবিকতার বেশ কয়েকটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। প্রশংসা পান সবার।
গতকাল শনিবার (১৫ এপ্রিল) ভোরে রাজধানীর ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেখানে শুরু থেকে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতায় অংশ নেয় পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেখানে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের ভূমিকার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রশংসা পায়। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন কনস্টেবল পরান সরকার ও আবেদুর রহমান। মুখে বাঁশি, মাথায় কাপড়ের বোঝা হাতে ভেজা শরীরে ব্যস্ত দেখা যায় পরান সরকারকে। যে ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশ কনস্টেবল পরান সরকারের বাড়ি ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে। তিন বছর আগে পুলিশে যোগ দেওয়া পরান সরকার কাজ করছেন রাজারবাগ পুলিশ অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম-পশ্চিম)।
ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পিওএম পশ্চিম বিভাগ থেকে ৪০ সদস্যের একটি টিম ঘটনাস্থলে যায়। যাদের মধ্যে ছিলেন পরান সরকার। তাদের মূল কাজ ছিল উৎসুক জনতাকে সরানো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি সেবা নির্বিঘ্ন করা।
শনিবার রমনা উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহর কার্যালয়ে কথা হয় পরান সরকার ও আবেদুর রহমানের সঙ্গে। পরান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভোর ৬টায় মেসেজ পাই ছুটতে হবে নিউ মার্কেট। সেখানে আগুন লাগছে। তিন প্লাটুন ফোর্স ঘটনাস্থলে পৌঁছে। সেখানে রমনার ডিসি, নিউ মার্কেটের এসি ও ওসি স্যারকে দেখতে পাই। ফায়ার সার্ভিসের একটার পর একটা গাড়ি আসছে। কিন্তু উৎসুক জনতার ভিড়ের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়েছিল। উদ্ধার কাজে সহযোগিতা না করে সবাই যেন মোবাইলে ভিডিও ও ছবি ধারণে ব্যস্ত। আমরা ঊর্ধ্বতন স্যারদের নির্দেশে রাস্তা ক্লিয়ার করি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাদের কাজে অংশ নেন।’
‘আগুনের খবরে ছুটে আসতে থাকেন ব্যবসায়ীরা। তারা এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিশেষ করে তিনতলার ব্যবসায়ীরা, তাদের মালামাল সরিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের কাছে এসে অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন। তাদের গগনবিদারী কান্না সহ্য হচ্ছিল না।
পুলিশপ্রধান আইজিপি সবসময় আমাদের মানবিক পুলিশিংয়ের ব্যাপারে মনোযোগী হতে বলতেন। আমাদের ট্রেনিংগুলোতে জনবান্ধব ও মানবিক পুলিশিংকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয়েছে। রমনার ডিসি স্যারও খুব অসহায় বোধ করছিলেন। স্যার মেসেজ পাঠান যে যেভাবে পারি যেন ব্যবসায়ীদের পুড়তে থাকা স্বপ্ন, শেষ সম্বল মালামালগুলো উদ্ধারে যেন সহযোগিতা করি।’
পরান সরকার বলেন, ‘সময়ক্ষেপণ না করে সহকর্মীর কাছে অস্ত্র জমা রেখে কয়েকজন মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। শুধু মনে হচ্ছিল যেভাবেই হোক ব্যবসায়ীর কান্না, চোখের পানির মূল্য আমাকে দিতে হবে। আমরা মার্কেটে প্রবেশ করি। যতটুকু সম্ভব হয়েছে ব্যবসায়ীদের মালামাল বের করে এনেছি। নিজের জীবনের মায়া করিনি।’
‘আমাদের পোশাক, মাস্ক, অগ্নিরোধের প্রস্তুতি ও ট্রেনিং তো ফায়ার ফাইটারদের মতো না। তবুও আমরা পুড়তে থাকা মার্কেটের ভেতরে আগুন, কালো ধোঁয়া, বিস্ফোরণ উপেক্ষা করে প্রবেশ করেছি। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করতে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে মার্কেটের ভেতর থেকে যখন মালামাল কাঁধে তুলে বের হচ্ছি তখন সামনে শুধু মানুষ আর মানুষ। দ্রুত বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তখন বাঁশি মুখে ফুঁ দিতে দিতে রাস্তা ক্লিয়ার করি, মালামাল মাথায় নিয়ে বের হই’— বলছিলেন পরান সরকার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনার ছবি অনেকে পোস্ট করেছেন, পরানে পরান জুড়িয়ে গেছে বলে প্রশংসা করেছেন। আপনার ছবি অনেক বেশি মানবিক নিবেদন তৈরি করেছে— বিষয়টি কি জেনেছেন, সিনিয়র অফিসাররাও নিশ্চয়ই আপনার প্রশংসা করেছেন; বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
কনস্টেবল পরানের উত্তরও যেন ছবির মতো পরান জুড়ানো। বলেন, ‘হিরো হওয়ার জন্য বা ভাইরাল হব ভেবে কিছু করিনি। নিজের মানবিক তাড়না, মনুষ্যত্ব, সিনিয়রদের নির্দেশনায় মূলত ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।’
‘আমার জন্য, আমার কর্মে যদি পুরো পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়, তাহলে আমি গর্বিত ও কৃতজ্ঞ থাকব। ভবিষ্যতে যেকোনো মানবিক কাজে যেন বাজি রাখতে পারি নিজের জীবন— এই প্রত্যাশা থাকল।’
সারারাত মোবাইল ডিউটি, সকালে অগ্নিকাণ্ডের খবরে যান নিউ মার্কেট
নিউ মার্কেট থানার কনস্টেবল আবেদুর রহমান। সারারাত মোবাইল পার্টির ডিউটি করেন। ফেরার সময় দেখতে পান ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আগুন। খবর দেন থানা পুলিশ ও রমনার ডিসিকে। নিজে লেগে পড়েন উদ্ধার কাজে।
আবেদুর রহমান বলেন, ‘বঙ্গ মার্কেটে লাগা আগুনে দেখেছি ব্যবসায়ীরা নিঃস্ব হয়েছেন। মার্কেটের অধিকাংশ কাপড় পুড়ে গেছে। এখানেও ব্যবসায়ীদের আহাজারি দেখছিলাম। খুবই খারাপ লাগছিল। তখনও মার্কেটে বেশি আগুন ছড়ায়নি। কিন্তু প্রচণ্ড গরম আর কালো ধোঁয়ায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বেগ পাচ্ছিলেন। পরিস্থিতি দেখে, ব্যবসায়ীদের আহাজারিতে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। সারারাত ডিউটি করেছি, রোজাও ছিলাম। রোজা অবস্থায় ঝুঁকি নিয়েই মার্কেটে ঢুকি, মালামাল আনতে থাকি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে ধন্য যে মানবিক এ কাজে নিজেকে জড়াতে পেরেছি।’
ফায়ার সার্ভিসকে পুলিশই প্রথম খবর দেয়। এ বিষয়ে রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. শহীদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সকালে মোবাইল পার্টির মাধ্যমে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসকে আগুনের খবর দেওয়া হয়। আমি নিজেও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। নিউ মার্কেট থানার ওসি, এসি, এডিসিসহ সবাইকে উপস্থিত হতে বলি।’
‘ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে আসে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। কিন্তু উৎসুক জনতার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ বেশ ব্যাহত হয়। আগুনও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের আহাজারি। উৎসুক জনতা কোনো সাহায্য-সহযোগিতা না করে ভিড় বাড়াতে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পর্যন্ত ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারছিল না। আমাদের পুলিশ সদস্যরা সেখানে দাঁড়িয়ে ভিড় কমানোর কাজে মনোযোগ দেয়। এদিকে, ব্যবসায়ীদের আহাজারি, কান্নাকাটি; অন্যদিকে উৎসুক জনতা শুধু দেখছে আর ভিডিও করছে। আমি নির্দেশনা দেই যে ব্যবসায়ীদের মালামাল পুড়ে যাওয়ার আগে যতটা সম্ভব সাহায্য করে বের করে আনতে।’
তাৎক্ষণিকভাবে নিয়োজিত পুলিশ ফোর্স থেকে একটা টিম গঠন করি উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করার জন্য। মালামাল পুড়ছে, ব্যবসায়ীরা চোখের সামনে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। এটা তাকিয়ে দেখা যায় না। নির্দেশনা পেয়ে আমাদের পুলিশ সদস্যরা অপরিসীম মানবিকবোধ নিয়ে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মার্কেটের ভেতরে প্রবেশ করে এবং মালামাল কাঁধে নিয়ে বের করে আনেন। পরান, আবেদুরদের ছবি এর প্রমাণ। আমাদের পুলিশ সদস্যরা হিরো হতে চায়নি। মানবিক পুলিশিংয়ের শিক্ষাই তাদের উদ্ধার কাজে ঝুঁকি নিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এমন মানবিক পুলিশই পারে দেশকে বদলে দিতে— বলেন রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. শহীদুল্লাহ।
জেইউ/জেডএস...