একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি কত দূর?
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা নৃশংসভাবে গণহত্যার স্বীকার হতে হয়েছিল নিরস্ত্র বাঙালিদের। গণহত্যাটি ৫২ বছর আগে হলেও আন্তর্জাতিকভাবে এর স্বীকৃতি এখনও আদায় করতে পারেনি বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টি অনেকটা আড়ালেই থেকে গেছে।
তবে ২০১৭ সালে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হওয়ার পর গত কয়েক বছর গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টি সামনে আসে। গণহত্যার বিষয়টির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায় বাংলাদেশ। সেজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কাজ করছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন থেকে ’৭১ এর গণহত্যার স্বীকৃতি মিলেছে। একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে আইন প্রস্তাব করেছে দুইজন আইনপ্রণেতা। তবে স্বীকৃতির বিষয়টি বিস্তৃত পরিসরে আদায় করতে চায় বাংলাদেশ। সেজন্য দেশে-বিদেশে কাজ চলছে।
গণহত্যার বিষয়টির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া খুব সহজ হবে না বলেও মনে করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তরা।
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। হিউম্যান রাইটস, হলোকাস্ট এবং গণহত্যা বিষয়ক কিউরেটরদের বাংলাদেশ সফরে নিয়ে আসা হচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলো ২৫ মার্চ পালন করছে, গণহত্যার ওপর আলোচনা করছে। তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে হলে বিষয়টি ছড়িয়ে দিতে হবে। আরও বেশি বেশি করে আলোচনা করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের গণহত্যায় আমরা ভিকটিম নেশান। ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা হয়েছিল তা সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে। পৃথিবীর একটি প্রান্তিক জায়গায় ছোট একটি দেশে যে ঘটনা ঘটেছে এটি কেবল মানুষের দুর্ভোগ ছিল না, মানুষকে সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিরোধ করতে হয়েছিল। আমাদের সংগ্রামে বিশ্বের জনগণের সমর্থন ছিল। সরকারগুলো ছিল না, বিশেষ করে পশ্চিমরা; তারা বিরোধিতা করেছিল।
মফিদুল হক বলেন, স্বাধীনতার পর আমাদের কিন্তু অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে। এখানে সবই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের কোনও কোষাগার ছিল না। ভারত-পাকিস্তান যখন ভাগ হয়েছিল তখন কিন্তু সম্পদ বণ্টন হয়েছিল। আমরা তো শূন্য একটা দেশ পেয়েছি, কিছুই ছিল না এখানে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার ছিল না। এখন যে দেশ স্বাধীন হয় তার পরদিন কিন্তু সেদেশের পতাকা ওড়ে জাতিসংঘে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে সামনে এগিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু ৭৫’-এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সবকিছু থমকে গিয়েছিল উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে দেশকে সাজানোর কাজে হাত দিয়েছিলেন। সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু ৭৫’এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সবই থেকে গেল। অনেক কিছুই চাপা পড়ে গেল।
মফিদুল হক বলেন, ২০১৭ সালে সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হলো। আমরা গণহত্যার একটা বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেতে চাই বা দাবি করছি। আমরা এখন জাতীয়ভাবে দিবসটা পালন করছি। বৈশ্বিকভাবেও বাংলাদেশ এটা করছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটা ১৯৭৬ সালে সেগুনবাগিচায় যাত্রা শুরু করে। সেটা ছিল জনগণের উদ্যোগে। মানুষের সমর্থনে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এরপর ২০১৭ সালে স্থায়ীভাবে আমরা জাদুঘর করলাম। জাদুঘরের কারণে পৃথিবীর সমমনা মানুষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ শুরু হয়ে গেল।
তিনি বলেন, হয়তো বিষয়টি উপস্থাপন করতে গিয়ে দেরি করে ফেললাম কী না -এটা আসতে পারে। এখন আমাদের একটা প্রতিষ্ঠান আছে। প্রতিষ্ঠানের হয়ে কথা বলা যাচ্ছে। গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টি তোলা যাচ্ছে। অনেক ডকুমেন্ট আছে আমাদের, অনেক ফ্যাক্টস জমা আছে জাদুঘরে। অনেক কিছু আর্কাইভ করা আছে। আর্কাইভ ক্রমাগত সমৃদ্ধ হচ্ছে।
গণহত্যার স্বীকৃতি পাবার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি। তিনি বলেন, আমাদের অনেক থিসিস, সলিড ডকুমেনটেশনের দরকার; রিসার্চ দরকার। আমাদের কিছু আছে, কিন্তু আরও দরকার। এটা নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। সামনে আরও কাজ হবে। আমরা খুব আশাবাদী।
স্বীকৃতির পেতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানান মফিদুল হক। তার ভাষায়, স্বীকৃতির অনেক রকম পথ আছে। আবার অনেক রকম প্রতিবন্ধকতাও আছে। স্বীকৃতি বলতে আমরা কেবল বুঝি জাতিসংঘের স্বীকৃতি। কিন্তু এখন জাতিসংঘ কোনও গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয় না। স্বীকৃতি হলো বৈশ্বিক স্বীকৃতি এবং সচেতনতা, সেটাই স্বীকৃতি।
এক্ষেত্রে আর্মেনিয়ার গণহত্যার স্বীকৃতি পাবার প্রসঙ্গ টানেন ট্রাস্টি মফিদুল হক। তিনি বলেন, আর্মেনিয়ার কেস একটা বড় উদাহরণ। তারা জাতীয় স্বীকৃতির জন্য আর্মেনিয়ার পার্লামেন্টে, বিভিন্ন কমিউনিটিতে, রিসার্চে বিষয়টি বারবার এনেছে। এতে করে বিস্তৃত পরিসরে তাদের স্বীকৃতি মিলেছে।
গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে বাংলাদেশের করণীয় জানান মফিদুল হক। তার ভাষ্য, আমাদের কাজ হবে এটাকে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনায় নিয়ে আসা। একাডেমিক এবং ইতিহাসের রিসার্চ, স্টাডি, পাবলিক প্রোগ্রাম। এ ধরনের বহু কাজ করতে হবে আমাদের। বৈশ্বিক স্বীকৃতি বিষয়ে আমরা আশাবাদী। কারণ আমাদের যে নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে, সাংস্কৃতিক বিনিময় হচ্ছে। এখানে বাহিরে থেকে স্কলাররা আসছেন। কিন্তু আরও অনেক পথ এখন পাড়ি দিতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের ভিকটিমদের ভয়েসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে আমাদের প্রজন্ম-৭১ বা বীরাঙ্গনা আছে। আমাদের অনেক কিছুই আছে এই স্বীকৃতির বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো।
গত ২০ মার্চ ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ‘বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে গণহত্যার স্বীকৃতি’ শীর্ষক বঙ্গবন্ধু লেকচার সিরিজে আলোচনার আয়োজন করেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে মূল বক্তা ছিলেন এশিয়া জাস্টিস অ্যান্ড রাইটসের কো-ফাউন্ডার ব্যারিস্টার প্যাট্রিক বার্জেস। তিনি বলেন, রুয়ান্ডা, আর্মেনিয়া, পূর্ব তিমুরসহ অনেক দেশেই গণহত্যা হয়েছে। বাংলাদেশও গণহত্যা হয়েছে। গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী বিষয়টি তুলতে হবে। বিষয়টি অব্যাহতভাবে তুলে ধরার পরামর্শ দেন তিনি।
ওইদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী বাংলাদেশিদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল, সেটি বারবার বলার ওপর জোর দেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্বীকৃতি আদায় করতে গণমাধ্যম, প্রবাসী বাংলাদেশি ও বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো সহায়তা প্রয়োজন।
গণহত্যার স্বীকৃতির চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়ে শাহরিয়ার আলম বলেন, জাতিসংঘে একটি গণহত্যা দিবস আছে এবং সে কারণে ২৫ মার্চ বিশ্বব্যাপী গণহত্যা দিবস করা যাবে না। আর্মেনিয়ার গণহত্যার পরে আর কোনও গণহত্যাকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেয়নি। কয়েকটি রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা হয়েছে এমনটি বলছে; তাদের আমরা বলছি—বাংলাদেশে আরও ব্যাপক গণহত্যা হয়েছে এবং সেটিকেও স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ১৯৭১ সালের গণহত্যার স্বীকৃতির আবেদন পর্যালোচনা করতে কানাডিয়ান মিউজিয়াম ফর হিউম্যান রাইটসের (সিএমএইচআর) হলোকাস্ট এবং গণহত্যা বিষয়ক কিউরেটর ড. জেরেমি মেলভিন মেরন বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। সে সময় ঢাকা পোস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কিউরেটর জেরেমি গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে ৭১’র গণহত্যার কথা ছড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে রাজনৈতিক সহযোগিতা কথা বলেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরেই চালানো হয় গণহত্যা। সেদিন ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
এর মধ্যেই প্রতিরোধযুদ্ধে নামে বাঙালি। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সেই সংগ্রামে প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। আর সেই পথ ধরে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
এনআই/এসএম