স্বর্ণায় প্রতারিত আরও ডজনখানেক নাম পেয়েছে পুলিশ
প্রেম-বিয়ের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদের শিরোনাম হওয়া অভিনেত্রী রোমানা ইসলাম স্বর্ণার ব্যাংকিং লেনদেনের তথ্য জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে পুলিশ। পাশাপাশি স্বর্ণার প্রতারণার শিকার আরও ডজনখানেক ভুক্তভোগীর তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলার এ বাহিনী। এদের সবার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এ অভিনেত্রী।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারণার মাধ্যমে বাড়ি-গাড়িসহ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া স্বর্ণার অপকর্মে মা ও ছেলে ছাড়াও জড়িত কয়েকজন আত্মীয়ের বিষয়েও তথ্য মিলেছে। যারা বিভিন্ন সময় স্বর্ণার কাছে আর্থিক সুবিধা আদায় করেছেন। সেসব তথ্যও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
ভুক্তভোগী সৌদি প্রবাসী ব্যবসায়ী কামরুল হাসানের দায়ের করা মামলায় গত বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া এলাকা থেকে মা আশরাফি ইসলাম শেইলি ও ছেলে আন্নাফিসহ স্বর্ণাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রতারণার মাধ্যমে বিয়ে, বিয়ের পর ফাঁদে ফেলে বিভিন্নভাবে নগদ টাকা, বাড়ি-গাড়িসহ প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্পদ অভিনেত্রী স্বর্ণা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে মামলায় উল্লেখ করেন ভুক্তভোগী কামরুল।
পুলিশ বলছে, এর আগেও বিয়ের ফাঁদ পেতে প্রতারণা করেছিলেন স্বর্ণা। তিনি তার প্রথম স্বামীকে তালাক দেন ২০১৭ সালে। পরে বিয়ে করেন এক উকিলকে। তালাক দেন তাকেও।
গত শুক্রবার (১২ মার্চ) মামলার বাদী কামরুল ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, ‘এক আত্মীয়ের মাধ্যমে পরিচয়ের পর স্বর্ণার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ হয়।’
তিনি জানান, নিজেকে বিধবা, অসহায় দাবি করে আর্থিক সহযোগিতা চান স্বর্ণা। বিভিন্ন অজুহাতে টাকাও নেন। দেশে ফেরার পর তাকে বাসায় ডেকে ফাঁদে ফেলে অর্ধনগ্ন করে ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করেন। সম্মানহানি ও মামলার ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক এই প্রবাসীকে বিয়ে করেন স্বর্ণা। পরে তালাকও দেন তাকে। সেই তালাকনামাও জাল। তার এসব প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য একটাই; অর্থ আত্মসাৎ।
কামরুলের দাবি, পরিচয় থেকে তালাক পর্যন্ত নগদ টাকা, বাড়ি-গাড়িসহ প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছেন স্বর্ণা। এসব অপকর্মে সহযোগী হিসেবে ছিলেন- স্বর্ণার মা আশরাফি ইসলাম শেইলি (৬০), ছেলে আন্নাফি (২০), ফারহা আহমেদসহ অজ্ঞাত যুবক।
তিনি বলেন, ‘উবারে গাড়ির ব্যবসা করবেন মর্মে টাকা ধার চান স্বর্ণা। পরিশোধের প্রতিশ্রুতিতে ২০১৮ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকে আড়াই লাখ টাকা, ইউসিবি ধানমন্ডি শাখার অ্যাকাউন্টে আট লাখ এবং ৮ নভেম্বর প্রবাসী বন্ধুর ডেমরা এলাকার স্ত্রীর কাছ থেকে ১২ লাখসহ মোট সাড়ে ২২ লাখ টাকা ধার হিসেবে নেন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে লালমাটিয়ার সি-ব্লকে অবস্থিত একটি আকর্ষণীয় ফ্লাট বিক্রি হচ্ছে। সেটা কিনে ফের বিক্রি করে লভ্যাংশ দাবি করেন স্বর্ণা; চান এক কোটি টাকা। ফ্লাটটি কেনার জন্য কয়েক দফায় বিভিন্ন মাধ্যমে মোট ৬৬ লাখ টাকা নেন। এরপর তিনি ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ তার বাসায় ডেকে অর্ধনগ্ন করে ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করতে বাধ্য করেন। দেনমোহর বাবদ নগদ ১০ লাখ টাকা ৩৩ ভরি সোনা, বিভিন্ন অজুহাতে চার লাখ টাকা মূল্যের হাতঘড়ি, দেড় লাখ টাকার দুটি আইফোন, ১২ লাখ টাকায় টয়োটা গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৮-৬৭০৫) কিনে নেন।’
এছাড়াও ১০ লাখের বেশি টাকা নানা কৌশলে হাতিয়ে নেন বলে দাবি করে গ্রেফতার স্বর্ণাসহ জড়িত প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান প্রবাসী কামরুল।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আরও ডজনখানেক লোক স্বর্ণার প্রতারণার শিকার হয়েছেন মর্মে তথ্য পেয়েছি। তাদের মধ্যে রয়েছেন- ব্যবসায়ী, উকিল, আছে সাংবাদিকও। তাদের একেকজনের প্রতারিত হওয়ার গল্প ভিন্ন ভিন্ন। কেউ প্রেমে, কেউ বিয়ে, কেউবা লালসার ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের অভিযোগ তদন্ত সাপেক্ষ। সবার অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার ইন্সপেক্টর (অপারেশন্স) দুলাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্বর্ণার আয়বহির্ভূত সম্পদের হিসেব তালাশ করছি। পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ ও রকেটের তথ্যসহ লেনদেনের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘স্বর্ণার প্রতারণায় সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন মা ও ছেলে। এছাড়াও আরও কয়েকজন আত্মীয় এতে জড়িত থাকার তথ্য আমরা পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে ও সামাজিক সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার শঙ্কায় তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এছাড়া তাদের প্রত্যেকের অভিযোগ যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আদালতের নির্দেশ মোতাবেক আমরা মাত্র এক দিন তাকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পেয়েছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আগামী সপ্তাহে রিমান্ড চেয়ে আবারও আদালতে আবেদন করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ মিললে বের করা সম্ভব হবে তার যাবতীয় প্রতারণার তথ্য।’
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদ বলেন, ‘মামলার বাদী ছাড়াও স্বর্ণার বিরুদ্ধে এর আগে প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইল করে দুটি বিয়ের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে এক জন ইতোমধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। স্বর্ণার ফাঁদে আর কেউ প্রতারিত হয়ে থাকলে তাদের যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে।’
জেইউ/এফআর/এইচকে