করোনার সংক্রমণ বাড়লে বইমেলা স্থগিত হতে পারে
সম্প্রতি দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এরমধ্যে অমর একুশে বইমেলা শুরু হচ্ছে। মেলা চলাকালে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হলে আমরা কঠিন সিদ্ধান্তে যাব। কারণ আগে তো জীবন।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন দেশে সম্প্রতি করোনা বেড়ে গেছে। আগে যেখানে দৈনিক ১০০ থেকে ২০০ জন করোনা আক্রান্ত হতো, এখন সেটা ২ হাজারের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) বাংলা একাডেমিতে অমর একুশে বইমেলা-২০২১ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামী ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো সীমিত আকারে আয়োজন হচ্ছে। রমনার বটমূলের অনুষ্ঠান সীমিত পরিসরে হবে। ফলে, সেইদিন বইমেলায় জনসমাগম বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এই দিনটিতে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে আমাদের বিশেষ পরিকল্পনাও হাতে নিতে হবে। এটা নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বইমেলা হবে উল্লেখ করে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, মহামারি যদি বেড়ে যায় এবং মেলা চালানোর মতো কোনো সুযোগ না থাকে, তাহলে একটা নতুন সিদ্ধান্ত তো নিতেই হবে। মহামারিকে তো আমন্ত্রণ জানানো যাবে না। সেক্ষেত্রে এমন হতে পারে, অপ্রিয় হলেও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা প্রার্থনা করছি যে করোনা সংক্রমণ সেই পর্যায়ে যেন না যায়, কঠিন সিদ্ধান্তে না যেতে হয়।
তিনি আরও বলেন, করোনার স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে এবারের বইমেলার আকার বেড়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ। আগের মতোই এবারও শ্রেষ্ঠ পুরস্কার, নান্দনিকতা সবকিছুই থাকবে। শেষ সময়ে আপনাদের কাছে আবেদন জানাব, যারা মিড়িয়াকর্মী আছেন, তারা জাতিকে সচেতন করার জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, যদিও এটা একটু কঠিন। এতে আশঙ্কা হলো, ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। সেই দিনের জনসমাগমের ঢল কীভাবে সামলাব। সেটা নিয়ে আমরা খুব আতঙ্কিত। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। কারণ রমনা বটমূলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সীমিত পরিসরে হচ্ছে। লোকের একটা বিশাল ঢল নামতে পারে। সেইদিন যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বইমেলা চালানো যেতে পারে, সেজন্য নতুন সিদ্ধান্ত নিতেও হতে পারে। যাতে করে অন্তত স্বাস্থ্যবিধিটা মানা যায়।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লা সিরাজী বলেন, স্বাস্থ্যবিধি নেই, বইমেলা নেই। মাস্ক নেই, বইমেলা নেই। আমাদের অনুরোধ এভাবে সংবাদপত্র-টেলিভিশনে এবার যেন প্রচার করা হয়। তাহলে মানুষ এটি যদি দেখে, সবাই সচেতন হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা কোভিড পরিস্থিতি ও অকালে বইমেলা করছি। এবার মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বইমেলা হবে। বৃষ্টি তাণ্ডব, ঝড়ের দাফট পাশাপাশি করোনা মহামারি। এর ভেতর দিয়ে শিশু-বৃদ্ধ ও তরুণরা যারা এ বইমেলায় অংশগ্রহণ করব, আসুন সবাই মিলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সহনশীল হয়ে মোকাবিলা করতে পারি, এটি কামনা করব।
মেলার প্রথম দিকে শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হবে না উল্লেখ করে বাংলা একাডেমির পরিচালক ও মেলার পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, আশা করি পরিস্থিতির উন্নতি হবে, সেটা পর্যবেক্ষণ করব, তারপর শিশুপ্রহর ঘোষণা করব। আমাদের শিশু চত্বরের যে বিশেষ ব্যবস্থা থাকে, সেটাও পরিস্থিতির উন্নতি হলে থাকবে। এবারও শিশু চত্বর মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে থাকবে।
লিখিত বক্তব্যে জালাল আহমেদ বলেন, এবারের অমর একুশে বইমেলা ২০২১ উৎসর্গিত হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। এবারের বইমেলার মূল থিম ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্ত ‘। ১৮ মার্চ বিকেল ৩টায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি বইমেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।
তিনি আরও বলেন, এবারের মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আকর্ষণ বঙ্গবন্ধুর নতুন বই আমার দেখা নয়াচীন-১৯৫২ এর ইংরেজি অনুবাদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২০ দেওয়া হবে। বইমেলা ১৯ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
এবার বইমেলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৭টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫৪টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৮০টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সব মিলেয়ে ৫৪০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৩৪টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মেলায় ৩৩টি প্যাভিলিয়ন থাকবে। আর লিটল ম্যাগাজিন চত্বর স্থানান্তরিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল মেলা প্রাঙ্গণে। সেখানে ১৩৫টি লিটল ম্যাগকে স্টল বরাদ্দের পাশাপাশি ৫টি উন্মুক্ত স্টলসহ ১৪০টি স্টল দেওয়া হয়েছে।
একক ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বই প্রকাশ করেছেন, তাদের বই ও বিক্রি/প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। বইমেলায় বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। বাংলা একাডেমির ৩টি প্যাভিলিয়ন, শিশুকিশোর উপযোগী বইয়ের জন্য ১টি এবং সাহিত্য মাসিক উত্তরাধিকারের ১টি স্টল থাকবে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে। অমর একুশে বইমেলা ২০২১-এর প্রচার কার্যক্রমের জন্য একাডেমিতে বর্ধমান ভবনের পশ্চিম বেদিতে ১টি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৩টি তথ্যকেন্দ্র থাকবে। বর্তমান সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণার অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই কর্তৃপক্ষ বইমেলায় তাদের নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন, তথ্যকেন্দ্রের সর্বশেষ খবরাখবর এবং মেলার মূল মঞ্চের সেমিনার প্রচারের ব্যবস্থা করবে।
এবার মেলার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব প্রান্তে নতুন একটি প্রবেশ পথ করা হয়েছে। প্রকাশকদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রমনা প্রান্তে একটি প্রবেশ পথ ও পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা। সব মিলিয়ে সোহরাওয়ার্দীতে ৩টি প্রবেশ পথ ও ৩টি বের হওয়ার পথ থাকবে। প্রত্যেক প্রবেশ পথে সুরক্ষিত ছাউনি থাকবে, যাতে বৃষ্টি ও ঝড়ের মধ্যে মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। বিশেষ দিনগুলোতে লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক, বাংলা একাডেমির ফেলো এবং রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত নাগরিকদের জন্য প্রবেশের বিশেষ ব্যবস্থা করা হবে।
করোনার স্বাস্থ্যবিধির বিশেষ উদ্যোগ হিসেবে বইমেলার প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। নিরাপত্তার জন্য মেলায় এলাকাজুড়ে ৩ শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বইমেলা সম্পূর্ণ পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত থাকবে।
১৯ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়কেন্দ্রিক আলোচনার পাশাপাশি বরেণ্য বাঙালি মনীষার জন্মশতবর্ষ উদযাপন এবং গত এক বছরে প্রয়াত বিশিষ্টজনদের জীবন ও কৃতি নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া মাসব্যাপী প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এ অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রতিদিনই রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ এবং আবৃত্তি।
বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০২০ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং ২০২০ বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা বই প্রকাশের জন্য ৩টি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে। এছাড়া ২০২০ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য এক প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ এবং এ বছরের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে।
এবারের মেলায় বাংলা একাডেমি নতুন ও পুনর্মুদ্রিত ১১৫টি বই থাকবে বলেও উল্লেখ করেন লিখিত বক্তব্যে।
এবারের মেলায় নতুন সংযোজন
এবার বইমেলার নতুন সংযোগ হচ্ছে- জাতির পিতার জীবন ও কর্ম-অধ্যয়ন এবং স্বাধীনতার মর্মবাণী জাতীয় জীবনে যাতে প্রতিফলিত হয় তার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৩টি প্রবেশ পথ থাকবে। ঝড়ের আশঙ্কা থাকায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাঠামো নির্মাণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪টি জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। নামাজের ঘর, টয়লেট ব্যবস্থা সম্প্রসারিত ও উন্নত করা হয়েছে। নারীদের জন্য সম্প্রসারিত নামাজ ঘর থাকবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে দুটি ফুডকোর্ট থাকবে।
এএইচআর/এসএম/এমএমজে