পঙ্গুত্বের ভার কেউই নিতে চায় না
লিমন মিয়া। কাজ করতেন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ক্যান্টিন বয় হিসেবে। দেড় বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুত্বের সঙ্গে লড়ছেন। চিকিৎসা নিচ্ছেন জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালে। কর্মক্ষমতার সঙ্গে উপার্জনের একমাত্র চাকরিটি হারিয়ে চিকিৎসা করাতেই যেন দম ফুরায় তার।
সোমবার (১৫ মার্চ) রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) সরেজমিনে গিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। দুর্ঘটনা-পরবর্তী মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, পঙ্গুত্বের ভার আসলে কেউই নিতে চায় না। যে কর্মস্থলে চাকরি করতাম, দুর্ঘটনার পরপরই বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এদিকে চিকিৎসা করাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পরিবারকে। সবমিলিয়ে এখন মনে হয়, পঙ্গুত্ব আমার জীবনে বিশাল অভিশাপ হয়ে এসেছে।
লিমন বলেন, সংসারের হাল ধরতে ইন্টারের (এইচএসসি) পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন নিজেই পরিবারের বোঝা হয়ে গেছি। দেড় বছর ধরে ক্রাচে ভর দিয়েই চলছে জীবন।
শুধু লিমন নন, প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা বিভিন্ন কারণে দেশে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন শত শত মানুষ। বেঁচে থাকলেও তাদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ (সোমবার) পালিত হচ্ছে বিশ্ব পঙ্গু দিবস। তবে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দিবসটি তেমন গুরুত্বসহকারে পালিত হয় না। অথচ দেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষের জীবনে পঙ্গুত্বের অভিশাপ নেমে আসে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির চেয়ে পঙ্গুত্বের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। পঙ্গুত্ব নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও তাদের ধারণা, দেশে প্রতি বছর দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, পুলিশের সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান সংস্থা ও বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪৫ জন এবং বছরে প্রায় পাঁচ হাজার প্রাণহানি ঘটে। দুর্ঘটনাস্থলে প্রায় ৫৫ শতাংশ এবং দুর্ঘটনার পর দুই ঘণ্টার মধ্যে ৩৫ শতাংশের মৃত্যু হয়।
জাতীয় অর্থোপেডিক পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বছরে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার থেকে এক লাখ ৩০ হাজার রোগী এখানে চিকিৎসা নেন। প্রায় ৫০ হাজার রোগী জরুরি বিভাগ থেকে সেবা নেন। এসব রোগীর মধ্যে বছরে ৩৫০ থেকে ৪০০ রোগী পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বিভিন্ন কারণেই মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেন। ফলে আলাদা করে এর কোনো হিসাব দেশে এখনও নেই। আবার পঙ্গুত্বের ধরনেও শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। তবে প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি মানুষকে পঙ্গু হতে হয় সড়ক দুর্ঘটনার কারণে।’
এদিকে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত তিন বছরে সড়কে প্রাণ গেছে ১৪ হাজার ৬৩৫ জনের। আহত হয়েছেন ১৯ হাজার ৪৬৩ জন। আহতদের মধ্যে স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন কতজন, সেই হিসাব নেই সংগঠনটির কাছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতিও বলছে, ‘আমরা তো বহু দূর, সরকারের কাছেই এর কোনো হিসাব নেই।’
নিসচার প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালে চার হাজার ৯২টি দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৮৫ জন লোক আহত হন। ২০১৯ সালে চার হাজার ৭০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন ছয় হাজার ৯৫৩ জন। এক বছরের ব্যবধানে আহতের সংখ্যা ২৪ শতাংশ কমেছে। তবে অনেক ছোট ছোট দুর্ঘটনায় আহতদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করা হয় বলে তা পত্রিকায়ও প্রকাশ হয় না। তাদের মধ্যে অনেকেই আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন, যা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি।
এদিকে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ৫৬ নম্বর ধারায় দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত, ক্ষেত্র মতে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিসচার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই নতুন আইনটি (সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮) পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। হলে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের উপকার হতো। আইনে এটি যুক্ত করতে আমাদের বহু সময় লেগেছে। সরকারকে বলেও কাজ হচ্ছে না। মূলত আন্দোলন ছাড়া কোনো কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। নতুন আইনটিও কলেজের ছাত্রদের আন্দোলনের ফলে হয়েছে। যারা আহত হয়ে মারা গেছেন বা পঙ্গু হয়েছেন তাদের পরিবারকে আমার ডাকে আন্দোলনে নামতে হবে।’
টিআই/এসএম/এমএআর/এমএমজে