প্রাণহানির চেয়েও পঙ্গুত্বের সংখ্যা দ্বিগুণ
• দেশে অর্থোপেডিক সার্জনের সংখ্যা প্রায় ১৫০০ জন
• বছরে কতজন পঙ্গুত্ব বরণ করছেন তার সঠিক হিসাব নেই
• এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থোপেডিক হাসপাতাল বাংলাদেশে
আজ ১৫ মার্চ, বিশ্ব পঙ্গু দিবস। প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে দিবসটি। তবে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে দিবসটি খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয় না। কিন্তু পঙ্গুত্ব নিয়ে এ দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত ভয়াবহ। যদিও প্রতিদিন অথবা বছরে ঠিক কতজন পঙ্গুত্ব বরণ করছেন, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান জানা নেই।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, নানা কারণে বছরে প্রায় ১২-১৫ হাজার মানুষকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকেই অজ্ঞতা, সঠিক পরিচর্যা, পুনর্বাসনসহ নানা সংকটে সীমাহীন কষ্ট নিয়ে পার করছেন জীবন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই সময় এর লাগাম টেনে ধরার। যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার।
বিশ্ব পঙ্গু দিবসে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পঙ্গুত্বের কারণ, প্রতিকার, প্রতিরোধ এবং আনুষঙ্গিক নানা বিষয় নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির মহাসচিব ডা. ওয়াহিদুর রহমান। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরেছেন ঢাকা পোস্টের ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি রাকিবুল হাসান তামিম।
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব পঙ্গু দিবসের গুরুত্ব কতটুকু?
ডা. ওয়াহিদুর রহমান : বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে দিবসটি দেশের মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জনবহুল দেশ বিবেচনায় প্রতিদিনই অনেক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনা, অসুস্থতাসহ নানাবিধ কারণে পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু এ সংক্রান্ত যথাযথ জ্ঞানের অভাব এবং অজ্ঞতার কারণে অনেক মানুষের মধ্যে পঙ্গুত্ব নিয়ে অসাড় ধারণা রয়েছে। পঙ্গুত্ব নিয়ে অবহেলা ও যথাযথ চিকিৎসার অভাবে অনেকের জীবনও চলে যায়।
বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দুর্ঘটনার পর সুচিকিৎসা নিশ্চিতে যথাযথ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে মানুষের গড়িমসির ফলে পঙ্গুত্বের হার দিন দিন বেড়ে চলেছে। তাই এসব বিষয়ে মানুষের আরও জানা প্রয়োজন।
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশে মানুষের পঙ্গুত্বের প্রধান কারণ কী?
ডা. ওয়াহিদুর রহমান : বাংলাদেশে পঙ্গুত্বের বড় কারণ হলো সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বহু মানুষের জীবনে পঙ্গুত্বের অভিশাপ নেমে আসছে। এসব দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্বের সংখ্যা প্রাণহানির চেয়ে দ্বিগুণ। অথবা দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে পারলে বাংলাদেশের পঙ্গুত্বের হার কমে যাবে।
ঠিক কতজন মানুষ বছরে পঙ্গুত্ব বরণ করছে তার সঠিক কোনো হিসাব নেই। কারণ, দুর্ঘটনার পর অনেককেই স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে পরে অনেকেই হয়তো স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে নিচ্ছেন। পঙ্গুত্বের আরও একটি কারণ হলো অসুস্থতা। কার্ডিয়াক ডিজিজ, ডায়াবেটিস বা হাইপারটেনশনসহ এ জাতীয় রোগেও মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারেন। তবে আমরা অর্থোপেডিক সার্জনরা বাংলাদেশে দুর্ঘটনাকবলিত মানুষের পঙ্গুত্ব নিয়েই বেশি চিন্তিত। সড়কে দক্ষ চালক এবং জনগণের সচেতনতা না থাকার ফলে আমাদের দেশে দুর্ঘটনা ও পঙ্গুত্বের সংখ্যা দুটোই বাড়ছে।
ঢাকা পোস্ট : দেশে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীদের পঙ্গুত্ব থেকে দূরে রাখার সুযোগ কতটুকু?
ডা. ওয়াহিদুর রহমান : দেখুন আমাদের দেশে অর্থোপেডিক সার্জনের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৫০০। আমরা মনে করি, দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় এ সংখ্যাটা অপ্রতুল। শুধু চিকিৎসক নয় বরং অর্থোপেডিক চিকিৎসালয়ও অপ্রতুল। তবে আশার বাণী হচ্ছে, বাংলাদেশে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি সারাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর জরুরি বিভাগে অর্থোপেডিক্সের চিকিৎসা তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া হচ্ছে। দ্রুত ও তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া হলে অনেক ক্ষেত্রেই পঙ্গুত্বের হাত থেকে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। তবে এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকদেরও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। দেখা যায়, রোগীর সঙ্গে এত পরিমাণ লোকজন আসে, তখন রোগীকে সামলানোর পরিবর্তে তাদের সঙ্গে আসা মানুষজনকে সামলানোই মুখ্য হয়ে পড়ে। আমরা চিকিৎসকরা সবসময় প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করি একজন রোগীকে পঙ্গুত্বের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু কিছু সমস্যা আছে যেগুলো ঘটলে আসলে কিছুই করার থাকে না। যেমন, বয়স্ক লোকজন যদি দুর্ঘটনায় আহত হন তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানো কষ্টসাধ্য। তারপরও রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে চিকিৎসার মাধ্যমে হয়তো কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো সম্ভব হয়।
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশে পঙ্গুত্বের সঠিক পরিসংখ্যান আপনাদের কাছে আছে কি না?
ডা. ওয়াহিদুর রহমান : আসলে এ ব্যাপারটি নিশ্চিত করে বলাটা আমাদের জন্য খুবই কঠিন। কারণ, দুর্ঘটনায় আহত সবাই আমাদের হাসপাতালে আসেন না। অনেকেই স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। আবার দুর্ঘটনা ঘটলেই যে পঙ্গুত্ব বরণ, ব্যাপারটা এমনও নয়। পঙ্গু অবস্থায় অনেকেই চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাচ্ছেন। তবে নিশ্চিত করে এ সংখ্যা বা পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই।
ঢাকা পোস্ট : দুর্ঘটনা ছাড়াও মানুষ আর কী কী কারণে পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারে?
ডা. ওয়াহিদুর রহমান : ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি, উচ্চ রক্তচাপজনিত বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা যখন দীর্ঘদিন ডাক্তারের শরণাপন্ন হন না বা নিয়মিত মেডিকেল চেকআপ করেন না, হঠাৎ করেই তাদের ইন্টার সেরিব্রাল হেমোরেজ অ্যাটাক হতে পারে। এতে অনেকে স্থায়ী পক্ষাঘাত অথবা পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারেন। অনেক সময় থেরাপি দেওয়া এবং চিকিৎসার মাধ্যমে কিছুটা রিকভারি করা যায়। অনেকেই আবার মারাও যান।
ঢাকা পোস্ট : পঙ্গু দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটি কী কী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে?
ডা. ওয়াহিদুর রহমান : বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটি সবসময় এ বিষয়গুলোতে মানুষকে সচেতন করে আসছে। আমরা মনে করছি, পঙ্গুত্ব রোধে বাংলাদেশের মানুষের যেমন স্বচ্ছ ধারণা থাকার প্রয়োজন, সেটা নেই। এজন্য আমরা শুধুমাত্র দিবস কেন্দ্রিক নয় বরং সবসময় মানুষকে সচেতন করছি। জনগণ, গণপরিবহনের চালকদের মধ্যে লিফলেট বিতরণ, র্যালি, কনফারেন্সসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চলমান আছে।
ঢাকা পোস্ট : কোন বিষয়গুলো মেনে চললে সাধারণ মানুষ পঙ্গুত্ব রোধ করতে পারবে?
ডা. ওয়াহিদুর রহমান : পঙ্গুত্ব রোধে মানুষকে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সড়কে চলাচলের সময় প্রশাসনের নির্দেশগুলো মেনে চলা, বিশেষ করে যে চালক গাড়ি চালাচ্ছেন তার লাইসেন্স আছে কি না, তিনি স্বাভাবিক আছেন কি না—এ ব্যাপারগুলো ভালোভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। একইসঙ্গে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। সর্বোপরি গণমানুষের সচেতনতাই পারে পঙ্গুত্ব রোধ করতে।
আরএইচটি/এসএম/এমএমজে/এমএআর/