প্রায় ৪ হাজার অগ্নিকাণ্ড সিগারেটের আগুন থেকে
>> সিগারেট-বিড়ির টুকরায় আগুন ১৬.০৮ শতাংশ
>> মোট অগ্নিকাণ্ডের ৩৮ শতাংশ বৈদ্যুতিক গোলযোগে
>> ২০২২ সালে মোট আগুনের সংখ্যা ২৪১০২টি
>> আগুনে ক্ষতি ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ টাকা
গত বছর রাজধানীসহ সারা দেশে আগুনের ঘটনা ঘটেছে ২৪ হাজার ১০২টি। এর মধ্যে সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে আগুন লাগার ঘটনা প্রায় ৪ হাজার। সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড অবশ্য যথারীতি শর্টসার্কিট থেকে। মোট অগ্নিকাণ্ডের ৫৪.৫৬ শতাংশ এই দুই কারণে।
২০২২ সালে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড নিয়ে সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফায়ার সার্ভিস। ওই প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর রাজধানীসহ সারা দেশে আগুনের ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ টাকা। ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্যদের সহযোগিতায় ১ হাজার ৮০৮ কোটি ৩২ লাখ ৬৪ হাজার ৬৬০ টাকার সম্পদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি আগুনের ঘটনা ঘটেছে শর্ট সার্কিট বা বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। ২০২২ সালে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে ৯ হাজার ২৭৫টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। যা মোট আগুনের ৩৮.৪৮ শতাংশ। এতে ক্ষতির পরিমাণ ১৩৩ কোটি ৬৭ লাখ ৪৮ হাজার ৪৯৭ টাকা।
এরপর সবচেয়ে বেশি আগুনের ঘটনা ঘটেছে বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে। এ সংখ্যা ৩ হাজার ৮৭৮টি। যা মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ১৬.০৮ শতাংশ। সিগারেট-বিড়ির জ্বলন্ত টুকরার আগুনে ক্ষতি হয়েছে ৩৪ কোটি ৬৪ লাখ ৮৭ হাজার ১৬৪ টাকা।
ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলা থেকে সৃষ্ট অগ্নি দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩ হাজার ৩৬৮, যা মোট অগ্নিকাণ্ডের ১৩.৯৮ শতাংশ। এতে ক্ষতির পরিমাণ ৮৩ কোটি ৫১ লাখ ২০ হাজার ৮২৯ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খোলা বাতির ব্যবহারে আগুনের সংখ্যা ৩২৭টি, যা মোট আগুনের ১.৩৭ শতাংশ।
এছাড়া, উত্তপ্ত ছাই বা জ্বালানি থেকে আগুন ৪৮৮টি, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলায় অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ৬০২টি, যন্ত্রাংশের ঘর্ষণজনিত অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ১৬৭টি, অগ্নিসংযোগ (শত্রুতামূলক ও উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক) ১৫৭টি, বজ্রপাত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ৪৮টি, বাজি ফোটানোর সময় ৯৪ অগ্নিকাণ্ড, মাত্রাতিরিক্ত তাপে ১৬৫ অগ্নিকাণ্ড, মেশিনের মিস ফায়ারে ১৬০টি, স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্বলনে ২৯টি, চিমনির স্ফুলিঙ্গ থেকে ১৩টি, স্থির বিদ্যুৎ থেকে ১৯টি, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ২৯টি, বিস্ফোরণ (সিলিন্ডার ও বয়লার) ৯৪টি, গ্যাস সরবরাহ লাইনের আগুন থেকে ৭৯৫টি, যানবাহনের দুর্ঘটনাজনিত কারণে ৩০৩টি এবং অজ্ঞাত কারণে ৪ হাজার ৯১টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে
ফায়ার সার্ভিসের ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৬০১টি।
ওই বছর বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে ৭ হাজার ৯৫৫টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। যা সে সময়কার মোট আগুনের ৩৬.৮২ শতাংশ।
সে তুলনায় ২০২২ সালে বৈদ্যুতিক গোলযোগে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বেড়েছে ১৩২০টি।
একইভাবে ২০২১ সালে বিড়ি-সিগারেটের টুকরো থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল ৩ হাজার ১৯৩টি। সে তুলনায় ২০২২ সালে এ থেকে অগ্নিকাণ্ড বেড়েছে ৬৮৫টি।
কমেছে হতাহতের সংখ্যা
২০২২ সালে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নি দুর্ঘটনায় ৭২ জন পুরুষ ও ১৩ জন নারী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩০৩ পুরুষ ও ৭৪ নারী।
২০২১ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল পুরুষ ১১৬ জন এবং নারী ১০৩ জন। আহত হয়েছিল পুরুষ ৪১৭ জন আর নারী ১৫৩ জন। ২০২২ সালে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা কমেছে।
গত ৭ বছরে অগ্নিকাণ্ডের কারণের শীর্ষে বৈদ্যুতিক গোলযোগ
গত সাত বছরের পরিসংখ্যান বলছে, অধিকাংশ আগুনের বড় কারণ বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট। নিম্নমানের তার ব্যবহারের কারণে এটি হয়ে থাকে।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ৯৯ হাজার ৭৫২টি। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের ঘটনা ৩৭ হাজার ৪০৪টি, যা মোট আগুনের ৩৭.৯২০ শতাংশ।
ফায়ার সার্ভিসের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীসহ সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে বেশি রয়েছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা বৈদ্যুতিক গোলযোগ। বহুতল বাণিজ্যিক ভবন কিংবা আবাসিক ভবনে নকল ইলেকট্রিক ক্যাবল (বৈদ্যুতিক তার) বা মানহীন তার ব্যবহারই এর অন্যতম কারণ। কখনও কখনও ওভার লোডের কারণেও আগুনের সূত্রপাত ঘটে।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণ মানহীন বৈদ্যুতিক তার বা ক্যাবলের ব্যবহার। আবার অথরাইজড বা যথাযথ ব্যক্তির মাধ্যমে না লাগানো। বাজারে ভেজাল বৈদ্যুতিক ক্যাবলও সহজলভ্য। সচেতনতার অভাবও রয়েছে ব্যক্তি পর্যায়ে। আমরা অধিকাংশই নিজ বাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগ চেক করি না। যেকোনো সংযোগ লুজ হতেই পারে। সেটা চেক করাটা গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘আগুন লাগলে অল্পতেই নেভানো সম্ভব যদি আমরা ভয় না পাই এবং নিয়ম জানি। অর্থাৎ ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু জানাশোনা থাকা জরুরি।’
সিগারেট-বিড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিড়ি-সিগারেটের বিষয়টি অবশ্যই সচেতনতার সঙ্গে নেভাতে হবে। ছোটখাটো বিষয় থেকে বড় আগুন আমরা দেখেছি। ধূমপানের বিষয়ে যেসব বিধিনিষেধ রয়েছে তা প্রতিপালন করলে এক্ষেত্রে আগুনের সংখ্যা কমে যাবে।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নগরায়ণ, শিল্পায়ন বাড়ছে। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবহারও বেড়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মানহীন, সস্তা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবহার বাড়ছে। যেখানে কোনো মনিটরিং নেই। এখানে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তদারকির অভাব রয়েছে।
তিনি বলেন, অনেক কারখানার ইনস্যুরেন্স নেই। মানুষের অসচেতনতা তো আছেই। প্রত্যেকটি দেশেই ইন্সপেকশনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ইলেকট্রিক ও ফায়ার সেফটির ইন্সপেকশন কার্যকরীভাবে বাড়াতে হবে।
আগুন লাগার পর নেভানো ফায়ার ফাইটিংয়েরে শেষ স্টেপ। কিন্তু আগুন যেন না লাগে সেজন্য তো প্রিভেনটিভ অ্যাকশন নিতে হবে। হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের অনুমোদন দেওয়ার আগে পরিদর্শন করা, ফায়ার ইকুইপমেন্ট, ইলেকট্রিক উপকরণ মানসম্পন্ন কি না তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার।
ফায়ার সার্ভিসের প্রিভেনটিভ উইংকে শক্তিশালী করার পরামর্শ
আইনগত দিক থেকে অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ফায়ার সার্ভিস বেশ শক্তিশালী। তবে শুধু ফায়ার ফাইটিং উইং শক্তিশালী করলেই হবে না এখানে প্রিভেনটিভ উইং বেশ দুর্বল। এই উইংকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক বলেন, ফায়ার সার্ভিসের প্রিভেনটিভ উইং এখনো দুর্বল। ফায়ার সার্ভিসের অর্গানোগ্রাম অনেক পুরনো। ফায়ার স্টেশন বাড়ে, লোকবলও বাড়ে। কিন্তু প্রিভেনটিভ উইং, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বা টানেলের উইং, মেট্রোরেল উইং কিছুই হয়নি। এগুলো করতে হবে।
সবচেয়ে বেশি আগুনের ঘটনা ঘটেছে শর্ট সার্কিট বা বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। ২০২২ সালে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে ৯ হাজার ২৭৫টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। যা মোট আগুনের ৩৮.৪৮ শতাংশ। এতে ক্ষতির পরিমাণ ১৩৩ কোটি ৬৭ লাখ ৪৮ হাজার ৪৯৭ টাকা।
তিনি বলেন, প্রচার-প্রচারণা বেশ হচ্ছে। কিন্তু ইন্সপেকশনে ঘাটতি আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে উপজেলা ৪৬৪টি। বিপরীতে আমার ইন্সপেক্টর আছে ২৬৮ জন। একজন ইন্সপেক্টরকে দুটি জেলা ইন্সপেকশন করতে হয়। এখানে আর কী কমেন্ট করব!
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. মিনারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোথাও অগ্নিকাণ্ড ঘটলে সংশ্লিষ্ট এলাকার পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি থেকে কোনো রিপোর্ট কি পাওয়া যায়? তারা কিন্তু একটা ইনিশিয়াল ইনভেস্টিগেশন করে। আসলে পাওয়া যায় না। অথচ তারা কিন্তু দেখতে পায় কোথায় সার্কিট ব্রেকারে সমস্যা হচ্ছে। কোনো সমস্যা হলে তারা মনিটরিং করতে পারে।
তিনি বলেন, ফায়ারের সার্ভিসের অগ্নিকাণ্ডের সোর্স কী? তারা কোনো সোর্স না পেলে সেটি শর্টসার্কিট বলে চালিয়ে দেয় কি না সেটাও দেখতে হবে। আসলে লংটার্ম ইনভেস্টিগেশন (তদন্ত) আমরা দেখি না।
জেইউ/এসকেডি/জেএস