২০৩০ সালের মধ্যে ছয় মেট্রোরেল পথ, থাকবে বিপণিবিতান
ঢাকা ও তার আশপাশে ২০৩০ সালের মধ্যে হবে ছয়টি মেট্রোরেল পথ। এর দৈর্ঘ্য হবে ১২৮ দশমিক ৭৪১ কিলোমিটার। পথে থাকবে ১০৪টি রেলস্টেশন। ছয়টি প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ হবে পথগুলো। প্রকল্পের আওতায় রেলপথ ছাড়াও গড়ে তোলা হবে বিপণিবিতান, হোটেল, বিনোদনকেন্দ্রসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
সরকার বলছে, মেট্রোরেল থেকে নেমে যাত্রীরা যাতে সহজে দরকারি পণ্য কিনতে পারেন, সেজন্যই এই ব্যবস্থা। মেট্রোরেল ঘিরে বাণিজ্যিক প্রকল্প বাস্তবায়নের নকশার কাজ চলছে। নকশা শেষ হলেই উন্নয়ন প্রকল্প ছক (ডিপিপি) তৈরি হবে বলে জানা গেছে ডিএমটিসিএল সূত্রে।
• ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় হচ্ছে ছয়টি মেট্রোরেল
• লাগবে এক লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা
• হবে বিপণিবিতান, হোটেল, বিনোদনকেন্দ্র
• প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি অর্থায়নের সম্ভাবনা
• জাইকা বা অন্য সংস্থা থেকেও অর্থ জোগাড় হতে পারে
জানা গেছে, এই ছয় মেট্রোরেল পথের কোনোটি হবে উড়াল, কোনোটি যাবে মাটির নিচ দিয়ে। আবার কোনোটি একইসঙ্গে উড়াল ও সুড়ঙ্গ দুই মাধ্যমেই যাবে। ইতোমধ্যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য গঠিত ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
ডিএমটিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল উড়াল মেট্রোরেল পথ নির্মাণের কাজ শেষ করতে চাই। এ জন্য জাপানের কোবে বন্দর থেকে ট্রেন জাহাজে করে রওনা দিয়েছে। আমরা সব মেট্রোরেল পথ যাত্রীবান্ধব করতে চাই। এ লক্ষ্যে একগুচ্ছ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত আছি।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, মেট্রোরেল পথে বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরির জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি অর্থায়নের সম্ভাবনা রয়েছে। তা না হলে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) বা অন্য কোনো দেশ বা সংস্থা থেকে অর্থ জোগাড় করা হবে।
বর্তমানে ঢাকায় উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬ এর কাজ চলছে। এটি দেশের প্রথম মেট্রোরেল পথ। এটি হচ্ছে উড়ালপথে। এই রেলপথসহ ২০৩০ সালের মধ্যে আরও পাঁচটি রেলপথ নির্মাণ করা হবে। প্রতিটি রেলপথে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলা হবে। ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) হাব পদ্ধতির ওপর ভর করে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, উত্তরা থেকে মতিঝিল রেলপথের মধ্যে উত্তরা প্রান্তে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলা হবে। মেট্রোরেলের ১৭টি রেলস্টেশন হবে এ পথে। প্রতিটি স্টেশন হবে কয়েকতলা উচ্চতার সমান। স্টেশনের পাশে জমি পাওয়া না গেলে স্টেশন প্লাজায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করা হবে। উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ রেলস্টেশনের মধ্যে প্রথম টিওডি হাব হবে উত্তরা সেন্টার রেলস্টেশনে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে ২৮ দশমিক ৬২ একর জমি কেনা হয়েছে এই হাব তৈরির জন্য। এজন্য জমি বাবদ রাজউককে প্রায় ৮৬৬ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
জানা গেছে, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোই–এর নির্দেশনা অনুসারে, এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন টিওডি হাব নির্মাণের নকশা প্রণয়ন এবং উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করবে।
রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় তিনটি মেট্রোরেল পথ, একটি বৃত্তাকার রেলপথ ও একটি চার লেন সড়কের সংযোগস্থল হতে যাচ্ছে। সেখানে বিপণিবিতান, হোটেল, বিনোদনকেন্দ্র, বাস টার্মিনালসহ বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তুলতে চায় ডিএমটিসিএল।
ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) ২০২৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বোঝার পর তা ২০১৪ সাল থেকে সংশোধন করে পরে চূড়ান্ত করা হয়। পরবর্তীতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত হয় রিভাইজড এসটিপি তথা আরএসটিপি।
সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (আরএসটিপি) সুপারিশ অনুসারে, দ্রুত গণপরিবহনের কাঠামো গড়ে তোলার অংশ হিসেবে প্রথম ধাপেই থাকতে হবে মেট্রোরেল ও বিআরটি। আরএসটিপির চূড়ান্ত পথনকশায় বলা হয়েছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে জনসংখ্যা ৫৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। এই সময়ের মধ্যে রাজধানী ও আশপাশে পাঁচটি মেট্রোরেল, দুটি বিআরটি ও ছয়টি উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হবে। যানবাহন চাহিদার ৬৪ শতাংশ পূরণ করতে পারবে এসব মেট্রোরেল ও বিআরটি।
ঢাকার চারপাশে তিনটি বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণ করা হবে। মহানগর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাসের রুট সমন্বয় করা হবে। আরএসটিপির মূল সুপারিশগুলোর মধ্যে এসব মেট্রোরেল পথ নির্মাণ করার কথা আছে। এ জন্য এক লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ দরকার হবে।
রাজধানীকে যানজটমুক্ত করতে ২০০৪ সালে প্রণীত হয় ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি)। এসটিপির লক্ষ্য ছিল ঢাকা মহানগরীর অভ্যন্তরীণ সড়কের উন্নয়ন, মহানগরীর প্রবেশ ও নির্গমন পয়েন্টগুলোতে যানজট নিরসন ও পরিকল্পিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ২০০৬ সালে অনুমোদনের পরবর্তী তিন বছরে এসটিপির সুপারিশ বাস্তবায়নে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পর্যায়ক্রমে প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির মধ্যেই গত প্রায় এক দশকে ঢাকা মহানগরী ও আশপাশের এলাকার জনসংখ্যা ও আয়তন অনেক বেড়ে গেছে।
এক নজরে ছয় মেট্রোরেল পথ
ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল রেলপথের কাজ চলছে এখন। এ মেট্রোরেল পথের ৫৮ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
এমআরটি লাইন-১ নামে মেট্রোরেল পথ হবে ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ও নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত হবে তার দুটো রুট। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর অংশে পাতাল রেলস্টেশন হবে ১২টি। অন্য রুটটি হবে উড়ালপথে, তাতে স্টেশন হবে ৯টি। উভয় রুটের সব বিস্তারিত সমীক্ষা ও নকশা হয়েছে।
হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত পাতাল ও উড়াল মিলে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে ২০২৮ সালের মধ্যে। তাতে ১৪টি রেলস্টেশন থাকবে। এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে।
২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ১৭ দশমিক ৪০ কিলোমিটার মেট্রোরেল পথ নির্মাণ হবে। এ পথের ১২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার হবে মাটির নিচ দিয়ে, বাকিটা উড়াল। প্রকল্পের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে। এ প্রকল্পের নাম এমআরটি লাইন-৫ নর্দান রুট।
এমআরটি লাইন-৫ সাউদার্ন রুট নামে হবে আরেকটি প্রকল্প। গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত উড়াল ও পাতাল সমন্বয়ে ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে মেট্রোরেলের এ পথ। এটি বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।
এছাড়া এমআরটি লাইন-৪ এর নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রেলরুটের পাশে উড়ালপথে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে এ মেট্রোরেল পথটি।
পিএসডি/এইচকে