রাজধানীর অলিগলিতে শীতের পিঠা বিক্রির ধুম
ছোট্ট কাঠের ভাসমান দোকান। তার ওপর জ্বলছে দুইটি চুলা। এক চুলায় সিলভারের পাতিলে পানি গরম হয়ে বাষ্প উঠছে। সেই পাতিলের মুখে ছোট্ট বাটিতে চালের গুড়া, নারিকেল আর খেজুরের গুড় মিশিয়ে কাপড় দিয়ে মুখ আটকে ঢেকে রাখা হচ্ছে। দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই ঢাকনা খুলে তোলা হচ্ছে গরম গরম পিঠা। পানির বাষ্পে ভাপের মধ্যে দানা গুড় গলে তৈরি হওয়া এই মিষ্টি মজাদার পিঠার নাম ভাপা পিঠা। এটি বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী পিঠা। সাধারণত শীত মৌসুমেই ঘরে ঘরে ভাপা পিঠা তৈরির ধুম পড়ে।
পাশেই আরেকটি চুলায় দেখা গেল লোহার কড়াই বসানো রয়েছে। সেই কড়াইয়ে চালের গুড়া, কুসুম গরম পানি ও লবণ দিয়ে মিশানো প্রণালি বিশেষ চামচের মাধ্যমে ঢেলে দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। চার থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হয়ে যাচ্ছে গোলাকার ও চ্যাপ্টা পিঠা। এর নাম চিতই পিঠা। অবশ্য অঞ্চল ভেদে এর আরও বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন-চিতল পিঠা, চিতই পিঠা, চিত্তে পিঠা, চিতে পিঠা বা সরা পিঠা। শীতের এই চিতই পিঠা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে খুবই জনপ্রিয়।
শীতের শুরু থেকেই পিঠা তৈরির এমন চিত্র রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক, দোকান, বাজার, মহল্লা এমনকি অলিগলিতে চোখে পড়ে। রাজধানীজুড়ে শীতকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এমন অসংখ্য ছোট-বড়, স্থায়ী, অস্থায়ী ও ভাসমান পিঠার দোকান। মূলত বিকেল থেকে রাত নয়টা-দশটা পর্যন্ত এসব দোকানে রমরমা বেচাকেনা চলে। মানুষজন দোকান ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে চুলা থেকে নামানো গরম ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা বা চিতই পিঠার স্বাদ নেন। অবশ্য চিতই পিঠার সঙ্গে আলাদা সরিষা ভর্তা, মরিচ-পেঁয়াজ ভর্তা, শুটকি ভর্তা, ডাল ভর্তাসহ নানান মুখরোচক আয়োজন থাকে। স্বাদ বাড়ানোর জন্য অনেকেই আবার চিতই পিঠা কড়াইয়ে দেওয়ার পর উপরে ডিমও ভেঙে দেন।
নিউ মার্কেটের বনলতা কাঁচা বাজারের সামনের অস্থায়ী পিঠার দোকানে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায় রেহেনা বেগমকে। ব্যস্ততার মধ্যেই জানালেন, সন্ধ্যার পর ক্রেতাদের প্রচণ্ড চাপ থাকে। গড়ে প্রতিদিন ১৪-১৬ কেজি আতপ চালের পিঠা তৈরি করতে হয়। বর্তমানে চিতই পিঠার তুলনায় ভাপা পিঠার চাহিদাই বেশি। অবশ্য প্রতিটি জিনিসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পিঠার দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় এক লাফে দ্বিগুণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ভাপা পিঠা তৈরির জন্য কি কি উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রধান উপাদান হচ্ছে চালের গুড়া। মিষ্টি করার জন্য গুড় দিচ্ছি। আর স্বাদ বাড়ানোর জন্য নারিকেল কুড়িয়ে শাঁস দেওয়া হচ্ছে। পিঠা যেন সুন্দর হয় বা ভেঙে না যায় সেজন্য আগে থেকেই চালের গুড়ায় সামান্য লবণ ও পানি মিশিয়ে রাখি। তারপর মাখানো চালের গুড়া চালনা দিয়ে চেলে হালকা নারিকেল চাঁছা ও গুড় মিশিয়ে নেই।
ভাপা পিঠা তৈরি করা কৌশলের ব্যাপার জানিয়ে রেহেনা বেগম বলেন, সবকিছু সুন্দরভাবে পরিমাণ মতো দিতে না পারলে পিঠা হয় না, ভেঙে যায়। মাটির ভাঁড় বা সিলভারের পাতিলের মুখে ফুটো ঢাকনা রেখে আটা দিয়ে মুখ আটকে দেই। তারপর পাতিলে অর্ধেক পানি দিয়ে চুলায় বসাই। বাষ্প উঠতে শুরু করলে ছোট্ট বাটিতে প্রথমে মাখানো চালের গুঁড়া, মাঝখানে নারিকেল আর সবার উপরে গুড় দিয়ে ভর্তি করি। এরপর বাটির মুখে পাতলা কাপড় দিয়ে মোড়ে ফুটন্ত হাঁড়ির ছিদ্রতে বসিয়ে ভাপা পিঠা তৈরি করি। প্রতিটি ভাপা পিঠা ২০-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার কেউ যদি ইচ্ছে করে টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে বেশি নারিকেল ও গুড় দিয়ে বড় পিঠা তৈরি করে খেতে চান সে সুযোগ রয়েছে বলেও জানান তিনি।
রেহেনা বেগমের পাশেই চিতই পিঠা বানাতে ব্যস্ত আব্দুর রহিম। কামরাঙ্গীরচর থেকে এসে প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে পিঠা তৈরি করে বিক্রি করেন তিনি। বললেন, চালের গুড়ার দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। লাকড়ির দাম বেড়েছে। গতবছর যে পিঠা ১০ টাকাতে বিক্রি করেছি এবার সেটি ২০ টাকা করতে হয়েছে। আর ডিম পিঠা বিক্রি করেছি ৩০ টাকায়। সেই সঙ্গে ভর্তা ফ্রি। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খুব হিমশিম অবস্থা। আমরাও অনেকটা নিরুপায়। তবে বেচাকেনা নিয়ে সন্তুষ্ট।
পিঠার ক্রেতারাও বলছেন শীতের আবহে গরম ধোয়া ওঠা পিঠা দেখে লোভ সামলাতে পারছেন না তারা। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় কথা হয় ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থী সাকিব হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, শীতে গ্রামের বাড়িতে ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা ও খেজুর রসের পিঠার নিয়মিত আয়োজন হয়। এবার পরীক্ষার কারণে এখনও বাড়িতে যেতে পারিনি। তাই মায়ের হাতের শীতের পিঠা এখনো খাওয়া হয়নি। তবে মাঝেমধ্যেই রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে পিঠা খাই। বাড়ির মতো স্বাদ হয় না তারপরও শীতের আবহে কিছুটা হলেও ভালো লাগে।
আবার অনেকেই বলছেন, শীত আসলে পিঠা না খেলে চলে না। বাড়িতে বা মেসে চালের গুড়া থেকে অন্যান্য উপকরণ দিয়ে পিঠা তৈরি করাও সহজ ব্যাপার নয়। তাই শীতের পিঠার চাহিদা পূরণের জন্য রাস্তার পাশের দোকানই তাদের ভরসা।
আরএইচটি/কেএ