ভিআইপিদের তদবিরে বঞ্চিত দুস্থরা
১৪ বছরের সন্তান জাহিদ, ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় তাকে রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন বাবা মো. সালাম (ছদ্ম নাম)। রংপুর থেকে এসে তিন দিন আগে ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর ওষুধপত্র কেনা যাতায়াতসহ বিভিন্নভাবে অনেক টাকা খরচ হয়েছে পেশায় অটোচালক এ বাবার। যে কারণে ছেলেকে কেমোথেরাপি দেওয়ার প্রয়োজনীয় ২৫ হাজার টাকা নেই তার কাছে।
অন্য এক রোগীর স্বজনের কাছে সালাম শুনেছেন, হাসপাতালের সমাজ সেবা কার্যালয়ে গিয়ে আবেদন করলে বিনামূল্যে গরীব রোগীদের কেমোথেরাপিসহ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এই কথা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে সালাম প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ছুটে যান সমাজ সেবা কার্যালয়ে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন সকাল ১০টার মধ্যেই আবেদন করার ফরম বিতরণ শেষ। এখন তাকে আরেকদিন অপেক্ষা করতে হবে।
সমাজ সেবা কার্যালয়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সালাম জানতে পারেন, আবেদন করার ৩-৪ দিন পর যাচাই বাছাইয়ে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শেষে ১-২ হাজার টাকা পেতে পারেন। আর ভাগ্য ভালো থাকলে ছেলেকে বিনামূল্যে কেমোথেরাপিও দেওয়াতে পারবেন। তবে এর কোনোটিই নিশ্চিত নয়।
এদিকে চিকিৎসক বলছে ছেলেকে দ্রুত কেমোথেরাপি দিতে হবে; তাই সালাম সমাজ সেবা কার্যালয়ের অনিশ্চিত আশার মধ্যে না থেকে এদিক-সেদিক ছুটতে থাকেন কেমোথেরাপি টাকা জোগাড় করতে।
শুধু সালামই নয়, তার মতো হাজারো রোগীর স্বজনরা এভাবেই বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন হাসপাতালের সমাজ সেবা কার্যালয়ে গিয়ে। যদিও অফিসটির একমাত্র কার্যক্রম গরীব ও দুস্থ রোগীরা যেন সেবা পান। কিন্তু অনুসন্ধান করে জানা যায়, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সমাজ সেবা কার্যালয়ে দুস্থদের থেকে বেশি সেবা পাচ্ছেন ভিআইপিদের স্বজন ও তাদের তদবিরের লোকজন। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ভিআইপিদের তদবিরের চাপে কার্যালয়টির কর্মকর্তারা দুস্থদের জন্য নির্ধারিত সেবা সামর্থ্যবানদের দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
বুধবার (১০ মার্চ) সকালে হাসপাতালের সমাজ সেবা কার্যালয়ে সরেজমিনে ঘুরে ভুক্তভোগী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া যায়।
হাসপাতালের ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একদিনে সর্বোচ্চ ৫টি ‘সাহায্য ফরম’ সমাজ সেবা কার্যালয় থেকে দেওয়া হয় দুস্থদের। এর বাইরে একটি ফরমও দেওয়া হয় না। আবেদন করার ৩-৪ দিন পর যার প্রয়োজন ১৫ হাজার টাকা তাকে দেওয়া হয় ২ হাজার টাকা। অন্যদিকে যার প্রয়োজন ১০ হাজার টাকা তাকে দেওয়া হচ্ছে ৫০০ টাকা। এর মধ্যে ভাগ্যবান কেউ একজন হয়তো পেয়ে যাচ্ছেন বিনামূল্যে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি।
নাটোর থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে রেডিওথেরাপি দেওয়ার জন্য এ হাসপাতালে এসেছেন ইকবাল হোসেন। অর্থ সঙ্কট থাকার কারণে গত কয়েক দিন ধরে সমাজ সেবা কার্যালয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন সাহায্যের জন্য।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, টাকার সঙ্কট থাকায় সাহায্যের জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু গত তিন দিন ধরে কোনো সুফল পাইনি। তবে আমাদের চোখের সামনেই অনেক সচ্ছল ব্যক্তি এসে সাহায্য নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আমি গরীব হয়েও বাবার কেমোথেরাপি বিনামূল্যে করার জন্য আবেদন করেও সাড়া পাচ্ছি না।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সমাজ সেবা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর তারা সরকার থেকে ৯-১১ লাখ টাকা পান দুস্থদের রোগীদের সাহায্য করার জন্য। এর মধ্যে প্রতি মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ করতে পারেন। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুদান এনে দুস্থ রোগীদের সাহায্য করার ব্যবস্থা করছেন তারা। তবে ভিআইপিদের চাপের কারণে সরকারি অনুদানের টাকা তাদের তদবির প্রার্থীদের কাছে চলে যায়। ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া কিছু অর্থ তারা দুস্থ রোগীদের দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সমাজ সেবা কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুস্থ রোগীদের সাহায্য করার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ পান তা পর্যাপ্ত নয়। এর মধ্যে আবার ভিআইপিদের তদবিরের কারণে সে অর্থও তারা প্রকৃত দুস্থদের দিতে পারছেন না। এছাড়া ভর্তি, সিট ও কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপিসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে সেবা দুস্থ রোগীদের দেওয়ার কথা তাতেও ভাগ বসাচ্ছে ভিআইপিদের তদবির। তবে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন দিনে অত্যন্ত ১-২ জন দুস্থ রোগীকে সাহায্য করতে।
এ বিষয়ে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালক ও হাসপাতালের সমাজ সেবা কার্যালয়ের সভাপতি অধ্যাপক ডা. কাজী মুশতাক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভিআইপিদের তদবিরের চাপ তো আছেই। তবে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন চিকিৎসা সেবা ‘সমাজ সেবা কার্যালয়ের’ মাধ্যমে দুস্থ রোগীদের বিনামূল্যে দেওয়ার চেষ্টা করি।
দিনে মাত্র পাঁচ জনকে সাহায্য আবেদনের ফরম দেওয়া হয় কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে আসা রোগীর সংখ্যা প্রচুর। সেই অনুযায়ী পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় দিনে অন্তত ৫ জন দুস্থ রোগীদের সাহায্যের ফরম দেওয়া হয়।
এমএসি/জেডএস