জাহালমের সেই ৩৩ মামলার চার্জশিট কতদূর
অপরাধ না করেও আসামি হয়ে তিন বছর কারাভোগ করা আলোচিত সেই জাহালমের মামলাগুলোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন (মামলা থেকে অব্যাহতি) এখনো দিতে পারেনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে ৩৩ মামলার তদন্ত শেষ করতে কমিশন থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুসরণ করে শিগগিরই চার্জশিট কমিশনে দাখিল করতে যাচ্ছে ৯ সদস্যের তদন্ত টিম।
একইসঙ্গে এসব মামলায় অধিকতর তদন্তে পলাতক মূল আসামি আবু সালেকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় চার্জশিটে তাদের আসামি করা হচ্ছে। যদিও অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন আবু সালেক। দুদকের খাতায় এখনো পলাতক তিনি। বিভিন্ন সূত্রানুসারে সালেক ভারত কিংবা নেপালে রয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে একজন তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মামলাগুলোর অধিকতর তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে কমিশন আমাদেরকে আগামী ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই রিপোর্ট জমা দেব। তদন্ত কাজ শেষ পর্যায়ে। যেখানে আবু সালেকসহ কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।’
এ বিষয়ে অপর এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৯ সালের শুরুতে ভুল আসামি হিসেবে জাহালমের ঘটনা বের হওয়ার পরই আবু সালেক দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। তাকে গ্রেপ্তার করতে সালেক ও তার আত্মীয়-স্বজনদের অন্তত ২০-২৫টি মোবাইল নম্বর ট্র্যাকিং করেছি, বিভিন্ন সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য নিয়েছি। তবে তাকে পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে আবু সালেককে গ্রেপ্তার করতেই এত সময়ের অপচয় হয়েছে।
দুদক ও বিভিন্ন সূত্রানুসারে, সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সোনালী ব্যাংক লোকাল অফিসের তৎকালীন ডিজিএম এ কে এম সাজেদুর রহমান বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় ২০১০ সালে প্রথম মামলা দায়ের করেন। যেখানে সোনালী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ১৮টি ক্লিয়ারিং প্রক্রিয়ায় জাল-জালিয়াতির বিষয়টি প্রাথমিকভাবে উদঘাটিত হয়। এর কিছুদিন পরে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেন বন্ধ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে।
এই প্রতিবেদনই দুদকে পাঠানো হয়। যার ওপর ভিত্তি করেই অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। পরবর্তীতে ২০১২ সালে তৎকালীন কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে ৩৩টি মামলা করা হয়। কিন্তু তদন্তকালে ঠাকুরগাঁওয়ের সালেকের বদলে টাঙ্গাইলের জাহালমকে আসামি করা হয়। আসামি হিসেবে তাকে আবু সালেক ওরফে জাহালম হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ফলে সালেকের স্থলে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছে টাঙ্গাইলের জাহালমকে।
বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি হিসেবে জেলে থাকার অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি ও মামলার বাদীসহ চার জনকে তলব করেন হাইকোর্ট। একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে’ ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না…’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন পরে আদালতের নজরে আনা হয়।
প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনটি হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি নিরীহ জাহালমকে দুদকের সব মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ওই দিনই মুক্তির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ভুল তদন্তের জন্য জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ওই দিনই গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান জাহালম। এরপর বিচারিক আদালত থেকে ওই সব মামলা অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। সাড়ে তিন বছর পর ওই সব মামলা থেকে জাহালমকে অব্যাহতি দিয়ে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন তৈরি করতে তদন্তের দায়িত্বে থাকা ৯ কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছে দুদক।
ঢাকা বিচারিক আদালতে দুদকের মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, ‘৩৩টি মামলা অধিকতর তদন্তের আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। সেই তদন্ত রিপোর্ট জমা হবে শিগগিরই। জাহালমকে যারা চিহ্নিত করেছিলেন তা তদন্তকারী কর্মকর্তারা নিজের ইচ্ছায় করেননি, ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভুলের কারণে এমনটা হয়েছিল। ব্যাংক থেকে চিহ্নিত করে দিয়েছিল জাহালমকে। এখন আসল আসামি আবু সালেককে চিহ্নিত করে চার্জশিট দেওয়া হবে।’
এই ঘটনায় দুদকের তদন্তকালে জাহালমের মামলার অন্যতম প্রধান আসামি মো. আমিনুল হক সরকার ওরফে মো. আমিনুল হক ওরফে হক সাবকে ২০১৯ সালের আগস্টে গ্রেপ্তার করেছিল দুদক। সংঘবদ্ধ জালিয়াত ও প্রতারক দলের অন্যতম এই হোতা দুদকের ৩৩টি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। গ্রেপ্তার হওয়ার পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড থেকে আত্মসাৎ করা ১৮ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা লোপাট করার কথা আমিনুল নিজ মুখে স্বীকার করেছিলেন বলে জানা গেছে।
এদিকে বিনা দোষে কারাভোগের কারণে ক্ষতিপূরণ চেয়ে এক রিটের শুনানি শেষে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রায় দেয় হাইকোর্ট। রায়ে ব্র্যাক ব্যাংককে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর গত ২৫ আগস্ট এ রায় স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে ব্র্যাক ব্যাংক। পরে ৫ লাখ টাকা জাহালমকে পরিশোধের শর্তে চেম্বার জজ ওই রায় স্থগিত করেন। এরপর গত ১ সেপ্টেম্বর ৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার জাহালমের বড় ভাই শাহানুরের হাতে তুলে দেয় ব্র্যাক ব্যাংক।
আরএম/এসএসএইচ/