অপ্রয়োজনে অফিস ও গাড়ি ভাড়ায় বিস্মিত সচিব
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে ‘বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে ১৭টি প্যাকেজে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬১৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। যদিও এখন পর্যন্ত অধিকাংশ প্যাকেজের কাজই শুরু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
এদিকে প্রকল্প এলাকায় কাজ শুরু না হলেও সিরাজদিখান উপজেলার গোয়ালখালী গ্রামে ৫ হাজার স্কয়ার ফুটের একটি অফিস ভাড়া নিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। প্রতিমাসে এই অফিস ভাড়া বাবদ ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় একটি গাড়ি ভাড়া করে প্রতিমাসে ৮০ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। অপ্রয়োজনে বিশাল অফিস ও গাড়ি ভাড়ার বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী।
সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে ‘বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ প্রকল্পটি পরিদর্শন করে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউনগুলোকে পরিবেশবান্ধব এবং অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল স্থানে স্থানান্তর/স্থাপনের লক্ষ্যে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ সব ধরনের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একটি কেমিক্যাল শিল্প পার্ক গড়ে তুলতে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। প্রস্তাবিত প্রকল্পে পরিকল্পিতভাবে প্রায় ২ হাজার ২৯০টি শিল্প-কারখানা/গোডাউন স্থাপন ও প্রায় ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।’
প্রতিবেদনে আইএমইডি সচিব উল্লেখ করেন, ‘সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পটি ১৭টি প্যাকেজের আওতায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১৭ নং প্যাকেজের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণের কাজ ২০১৯ সালের জুনে এবং প্যাকেজ ১৬-এর ভূমি উন্নয়নের কাজ চলতি বছরের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। পূর্ত কাজের অন্যান্য প্যাকেজের কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাব্য সময়ও চলতি বছরের জুনে রয়েছে। ডিপিপি অনুযায়ী চলতি বছরের জুনে এই ১৭টি প্যাকেজের মধ্যে ১৬টি প্যাকেজের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রকল্পটির ভূমি অধিগ্রহণ কাজ শেষ হয়েছে এবং ভূমি প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। কিন্তু ভূমি উন্নয়ন ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ বাস্তবে শুরু হয়নি।’
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক সাইফুল আলম জানান, ‘তারা পার্শ্ববর্তী একটি শপিং কমপ্লেক্সে এ প্রকল্পের কাজ দেখাশোনা করার জন্য মাসিক ৭৮ হাজার টাকায় অস্থায়ী অফিস ভাড়া নিয়েছেন।’ যদিও অস্থায়ী অফিসের প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পাচ্ছেন না আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘গত তিন বছর ধরে প্রকল্পের আওতায় একটি ডাবল কেবিন পিকআপ এবং কিছু সংখ্যক কম্পিউটার কেনা হয়েছে। প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক। প্রকল্প পরিচালক জুন ২০২১ সালে পিআরএলে যাবেন। কাজের প্রতি তার তেমন আগ্রহ নেই বলে দেখা গেছে। প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে দ্রুত একজন পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই প্রকল্পের মূল কাজ হচ্ছে মাটি ভরাট। মাটি ভরাট হয়ে গেলে বাকি কাজ এক দুই মাসের মধ্যে টেন্ডার করা হবে। টেন্ডার হয়ে গেলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্প সমাপ্ত করা সম্ভব হবে। গত সভায় মাটি ভরাটের কাজ অনুমোদন হয়ে গেছে। চলতি মাসের মধ্যেই ভরাটের কাজ শুরু করতে পারব বলে আশা করছি। আমরা প্রথমে বিমানবাহিনী কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে মাটি ভরাটের কাজটি করার জন্য প্রস্তাব করেছি। ওই সময় আমাদের এ প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়নি। ওই সময় অনুমোদন হয়ে গেলে এতদিন মাটি ভরাটের কাজটি হয়ে যেত।’
প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘এসব কাজ করার জন্যই সাইট অফিস নেওয়া হয়েছে। ডিপিপি’র সংস্থান অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের সম্মতিতেই গাড়ি ও অফিস ভাড়া করা হয়েছে। সাইট অফিসে আমরা ১৫ জন কাজ করি। এছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও কনফারেন্স রুমের জন্য ৫ হাজার স্কয়ার ফুটের অফিসটি প্রয়োজন ছিল। প্রকল্প এলাকায় ওই অফিসটি ছাড়া ভাড়া নেওয়ার মতো আর কোনো বাড়ি ছিল না। ফলে রেট শিডিউল অনুযায়ী সাইট অফিসের প্রথম ও দ্বিতীয় ফ্লোরটা ভাড়া নেওয়া হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাইট অফিসটির অবস্থান গ্রামে। কিন্তু গণপূর্ত অধিদফতরের রেট শিডিউলে যে ভাড়া উল্লেখ করা হয়েছে, তা সদর উপজেলার।
এ বিষয়ে আইএমইডি সচিব বলেন, ‘সদর উপজেলা ও প্রকল্প সাইট এলাকার বাড়ি ভাড়া রেট কখনও এক হতে পারে না। কারণ প্রকল্প এলাকাটি একদম গ্রামের মধ্যে।’
এক প্রশ্নের জবাবে পিডি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এই প্রকল্পটি সংশোধন করে ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। কারণ ভূমি অধিগ্রহণে ১ হাজার কোটি টাকা ধরা ছিল। ভূমি অধিগ্রহণে আমাদের ৪৭০ কোটি টাকাও খরচ হয়নি। ডিপিপিতে যা ধরা ছিল তার তুলনায় অনেক কম অর্থে জমি ক্রয় করতে পেরেছি। নিয়ম অনুযায়ী অর্থবছর শেষে টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত যাবে। এর বাইরেও ভবিষ্যতে যদি প্রকল্পের কোনো খাতে টাকা বাড়ে তাহলে এখান থেকে নিয়ে খরচ করতে পারব।’
ঢাকার এত কাছে প্রকল্প এলাকা হওয়ার পরও কেন এত টাকা দিয়ে সাইট অফিস ভাড়া নেওয়া হয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়। এটা আমার কাছে অর্থের অপচয় বলে মনে হয়েছে। প্রকল্পের দৃশ্যমান কোনো কাজ শুরু না করেই প্রতিমাসে ৮০ হাজার টাকায় গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। এই বিষয়টাও আমার কাছে যৌক্তিক বলে মনে হয়নি
প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, আইএমইডি সচিব
সার্বিক বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অকারণে অর্থ ব্যয়ের প্রবণতা সবসময় কর্তৃপক্ষের মধ্যে থাকে। এর আগেও রূপপুরে বালিশ কেনা, বেশি দামে পর্দা কেনাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে এ ধরনের কাজ হয়েছে। এগুলো কঠোরভাবে দমন করা উচিত। এক্ষেত্রে আইএমইডির পরিদর্শনের রিপোর্ট ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো প্রকল্পই সময়মতো শেষ হয় না। দুই-তিন বছর আগে বিশ্বব্যাংক আমাদের এডিপি বাস্তবায়নের ওপর একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল, সেখানে ৩০ থেকে ৩২টি প্রকল্প চিহ্নিত করেছিল, যেগুলো আগামী ১০০ বছর লাগবে শেষ করতে। প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। প্রকল্প বাস্তবায়নে শুধু দক্ষতা থাকলে হবে না, এখানে সমন্বয় থাকতে হবে। যারা প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হবে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। জবাবদিহিতার আওতায় না আনতে পারলে কাজ হবে না। মোট কথা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর পুরান ঢাকায় প্রায় ৪ হাজার রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম রয়েছে। দাহ্য এসব রাসায়নিক গুদাম এলাকার বাসিন্দাদের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ড এবং ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রকল্প নেওয়া হয়।
এসআর/এসকেডি/এমএমজে