বিয়ে ভেঙেই বীর তিনি!
মাত্র নবম শ্রেণির ছাত্রী। ওই সময়ই বিয়ের প্রস্তাব। ছেলে ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের। মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়েতে রাজি পরিবার। বিয়ের দিনক্ষণ চূড়ান্ত, আয়োজনও সম্পন্ন, কিন্তু আগের রাতেই কনে উধাও! এভাবে আরও একবার বাল্যবিয়ের বলি হতে বসেছিলেন। কিন্তু নিজের অনড়, অটুট অবস্থানের কারণে সে বিয়েও হতে পারেনি। এরপর নিজ প্রচেষ্টাতেই তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। তিনবারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকও।
নিজের বিয়ে ঠেকিয়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তা অব্যাহত আছে আজও। এখনও কোথাও বাল্যবিয়ের খবর শুনলে ছুটে যান প্রথমেই। একক প্রচেষ্টায় তিনি চট্টগ্রামে বন্ধ করেছেন হাজারো বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে চট্টগ্রামে কিংবদন্তির সম্মান পাওয়া এই লড়াকু নারী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তিন তিনবারের নির্বাচিত সাবেক কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু।
বিয়ের দাওয়াত পান না রানু!
১৯৮৭ সাল থেকে বাল্যবিয়ে বন্ধে কাজ করছেন রানু। ‘দাওয়াত দিলেই বিয়ে ভাঙেন রানু’ এই ভয়ে এখন আর কেউ বিয়ের দাওয়াত দেন না তাকে! রানু বলেন, বাল্যবিয়ে ঠেকাতে ঠেকাতে এখন একটা রব উঠেছে, ‘রানু বিয়ে ভেঙে দেন’। এ কারণে অনেকে আমাকে দাওয়াত দিতে ভয় পান। আবার অনেকেই আগে ওয়াদা করান আমি বিয়ে ভাঙব না।
এর সত্যতা পাওয়া যায় আব্দুছ ছবুর নামে এক রিকশাচালকের কথায়। তিনি জানান, তার মেয়ে রওশনের বিয়ে ঠিক হয়। স্থানীয় কাউন্সিলর হিসেবে রানুকে দাওয়াত দেন, চান আর্থিক সহযোগিতা। কিন্তু কাউন্সিলর উল্টো বিয়েটি ভেঙে দেন! কারণ, রওশন তখন পড়তো পঞ্চম শ্রেণিতে! এর তিন বছর পর আব্দুছ ছবুর বিয়ে দেন মেয়েকে। তবে এবার আর ভুল করেও বিয়ের দাওয়াত দেননি রানুকে।
লড়াই শুরু নিজেকে দিয়েই
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কীভাবে শুরু করলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে রানু বলেন, ‘প্রথমবার আমার বড় বোনের সঙ্গে আমারও একইদিনে বিয়ে ঠিক হয়। তখন বললাম, আমি পড়ালেখা করব। পরিবার জোর করায় প্রতিবাদী হয়ে উঠলাম। বললাম, আমাকে বিয়ে দিলে আত্মহত্যা করব। এরপর নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায়ই আমার বিয়ে চূড়ান্ত করে ফেলে পরিবার। বর, বিয়ের পিঁড়ি সবই প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তার আগেই আমি পালিয়ে যাই। সেই থেকেই শুরু আমার লড়াই। অব্যাহত আছে এখনও। এখনও কোথাও বাল্যবিয়ের খবর শুনলে ছুটে যাই। তাকে উদ্ধার করি। সহযোগিতা করি।’
আগে গালি দিত, এখন তালি দেয়!
বাল্যবিয়ে ঠেকাতে গিয়ে অনেকের রোষানলে পড়েন রানু। এমনকি অনেক জনপ্রতিনিধিও তার বিরুদ্ধাচরণ করতেন। এলাকার মানুষ গালি দিত, পাগল ডাকতো। কিন্তু সেই তারাই এখন রানুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাল্যবিয়ে রোধে সচেতনতা তৈরিতে তারাই এখন রানুকে অতিথি করেন। তার বক্তৃতায় তালি দেন!
রানু বলেন, ‘প্রথমদিকে অনেক কষ্ট হতো। আসলে তো লড়াইটা শুধুমাত্র একটা বিয়ের বিরুদ্ধে না। এই লড়াই প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, সামাজিক পদ্ধতি ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনেকগুলো মানুষের বিরুদ্ধে ছিল। তাই লড়তে হয়েছে অনেকগুলো শক্তির বিরুদ্ধে। তবে দেখে ভালো লাগে, একসময় যারা আমার বিরোধিতা করত তারাই এখন বড় বড় আয়োজন করে বাল্যবিয়ে ঠেকানোর শপথ নেন। এটাই আমার জয়, এটাই আমার প্রাপ্তি।’
রানু আরও বলেন, ‘রংপুর থেকেও যখন বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে ফোন আসে, কিশোরগঞ্জ কিংবা দ্বীপাঞ্চল সন্দ্বীপ থেকে বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য যখন অনুরোধ আসে, তখন সত্যিই খুব ভালো লাগে, দারুণ উপভোগ করি বিষয়টা।’
কেএমআই/এইচকে