ভাসানচর প্রকল্প মানবতার পরম দৃষ্টান্ত
রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচর নিজ দেশের চেয়ে নিরাপদ। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ে সামাজিক ও অবকাঠামোগত দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক বেশি স্থিতিশীল। ভাসানচর প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ মানবতার পরম এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
‘বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর : সুবিধা এবং প্রতিকূলতা’ শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শিশুদের নিজ ভাষায় পাঠদানসহ বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
শনিবার (৬ মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। সেমিনার আয়োজন করে শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ। ‘সেন্ট্রাল ফাউন্ডেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ’র (সিএফআইএসএস) সহায়তায় এ গবেষণা পরিচালিত হয়।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেন্ট্রাল ফাউন্ডেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (সিএফআইএসএস) চেয়ারম্যান কমোডর এম এন আবসার। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন, গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম প্রমুখ।
সেমিনারে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভাসানচরের সামাজিক ও পরিবেশগত স্থায়িত্ব পর্যবেক্ষণ করা। এ গবেষণায় দেখা গেছে, ভাসানচর একটি নতুন দ্বীপ হিসেবে পুরোপুরি বসবাসযোগ্য। এ দ্বীপে তৈরি রাস্তা, আশ্রয়কেন্দ্র এবং ৯ ফিট উঁচু বাঁধ দ্বীপটিকে টেকসই করেছে। বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মাধ্যমে এই দ্বীপটি ডুবে যাবার কোনো আশঙ্কা নেই।
কক্সবাজারে থাকা রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সমস্যা গবেষণায় উঠে এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও পুরো ক্যাম্পে সমানভাবে নেই। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ছোটখাটো দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের চিত্র পাওয়া গেছে। ইয়াবা, অবৈধ অস্ত্র, পতিতাবৃত্তি, মানবপাচার এবং মাদকের বিস্তার ও কেনাবেচার দিকও গবেষণায় উঠে এসেছে।
ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে আরও বলেন, রোহিঙ্গা শিশুদের নিজ ভাষায় পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ পালনের ব্যবস্থা করতে হবে। গবেষণা প্রতিবেদনের সুপারিশে ভাসানচরে ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প স্থাপনের পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে।
ভাসানচরে ৫শ-৯শ বছর পর আবার একটা ভূমিকম্প হতে পারে। ১৯৭০ সালের মতো ঘূর্ণিঝড়েও বড় ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
অধ্যাপক মাকসুদ কামাল
সেমিনারে অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প কিংবা সুনামি হলে ভাসানচরের কী হবে? এখন যেখানে ভাসানচর আছে তার আশেপাশে অর্থাৎ আরাকানে ১৭৬২ সালে একটি ভূমিকম্প হয়েছে। সে ভূমিকম্পে এ অঞ্চলের অনেক দ্বীপ তলিয়ে গেছে। ৫০০-৯০০ বছর পর আবার একটা ভূমিকম্প হতে পারে। সেক্ষেত্রে হাতে এখনও ২৫০ বছরের বেশি সময় আছে।
তিনি আরও বলেন, আরেকটা বিষয় হলো ঘূর্ণিঝড়। দ্বীপটির উপর দিয়ে কোনো ঘূর্ণিঝড়ের পথ যায়নি, গেছে দ্বীপটির দুই পাশে। যদি ১৯৭০ সালের মতো ঘূর্ণিঝড়ও হয় তাও মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা এই দ্বীপে রাখা হয়েছে। সরকার এখানে ১৯ ফুট উঁচু বাঁধ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। এছাড়াও বন, ওয়েভ ব্রেকারসহ এখানে চার ধরনের বেরিয়ার থাকার কারণে ৭০ সালের মতো ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
তিনি ভাসানচরকে রোহিঙ্গাদের জন্য নিজ দেশের চেয়েও নিরাপদ স্থান উল্লেখ করে বলেন, রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে যেসব জায়গায় আছে যেকোনো সময় সেখানে পাহাড়ধস ও ভূমিধসের কারণে লাখেরও বেশি মানুষ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। সামাজিক, শারীরিক ও অবকাঠামোগত দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচর তাদের নিজ দেশের থেকেও নিরাপদ।
বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কক্সবাজারের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে জটিল করে তুলছে।
শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম
শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কক্সবাজার অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে জটিল করে তুলছে।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম বলেন, কক্সবাজার দেশের একটি বড় পর্যটন এলাকা। বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপে এ এলাকার পরিবেশগত ভারসাম্যে প্রভাব পড়েছে। গত দুই বছরে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিয়েছে। তারা তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করতে চায়। যে সুযোগটা কক্সবাজারে নাই, সেটা তারা ভাসান চরে পাচ্ছে। রোহিঙ্গা শিশুদের নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ করে দিতে হবে। তাদেরকে তাদের নিজ ভূমিতে পাঠানোর ব্যবস্থাও করতে হবে। এ জন্য প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সহযোগিতা লাগবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, যেখানে ভারত, চীন, আমেরিকা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরের প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার মানবতার পরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এইচকে