কপ-২৭ সম্মেলন : দাবি আদায়ে মিশরে আওয়াজ তুলবে বাংলাদেশ
জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে মিশরের শার্ম এল-শেখে বসছে কপ-২৭ জলবায়ু সম্মেলন। রোববার (৬ নভেম্বর) থেকে শুরু হতে যাওয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবায়ু সম্মেলনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে হাজির হবে।
২০২৫ সাল পর্যন্ত উন্নত দেশগুলো প্যারিস চুক্তির আওতায় প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার যে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে, এবারের সম্মেলনে তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হবে ঢাকার পক্ষ থেকে। পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের পর এ বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর অবস্থান কী হবে, সেটি আলোচনায় রাখতে চায় ঢাকা।
এর বাইরে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ইস্যু নিয়ে কথা বলবে ঢাকা। ঢাকার চাওয়া হচ্ছে, ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাইরে লস অ্যান্ড ড্যামেজের জন্য আলাদা অর্থায়ন করতে হবে। এ ইস্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত তথা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা এবং বন্যাসহ নানাবিধ কারণে যেসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব আন্তর্জাতিকভাবে দেখতে হবে। এছাড়া অভিযোজন ও প্রশমন, সবুজ প্রযুক্তি হস্তান্তরে উন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হবে।
৬ নভেম্বর শুরু হয়ে মোট ১৩ দিন চলবে এবারের কপ-২৭ সম্মেলন। এবারের আয়োজনে ১৯৮টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বা তাদের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। তবে গতবার গ্লাসগোতে কপ-২৬-এ অংশ নিলেও এবার মিশর যাচ্ছেন না বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শার্ম এল-শেখে বাংলাদেশের এজেন্ডা নিয়ে হাজির হবেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
কপ-২৭ এ বাংলাদেশের এজেন্ডা জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, জলবায়ু ইস্যুতে কোনো বিষয় কিন্তু সুরাহা হয়নি। ২০২৫ পর্যন্ত ১০০ বিলিয়ন ডলারের যে প্রতিশ্রুতি আছে উন্নত দেশগুলোর, সেটা এখনও পূর্ণ হচ্ছে না। সেটার জন্য একটা কনক্রিট আলোচনা দরকার। কীভাবে টাকাটা আসবে সেটার আলোচনা হওয়া দরকার। গতবারও এটা তোলা হয়েছে, সে কথাগুলো আবারও আসবে। তবে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসবে কী না সেটা বলা যাচ্ছে না। ২০২৫ এর পর কী হবে সে আলোচনা হওয়াটা খুবই জরুরি। কারণ ২৫ কিন্তু এসে গেছে। উন্নত দেশগুলো আগের অর্থায়ন কীভাবে পূরণ করবে, পরবর্তী সময়ে তারা টাকাটা কীভাবে দেবে বা তাদের এ বিষয়ে চিন্তাধারা কী, এটি খুব বড় করে আলোচনার বিষয়।
মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা বলেন, তৃতীয়ত, লস অ্যান্ড ডেমেজের কথাটা খুব হচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে, কপ-২৭ শুরুর আগে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি। তিনি তার আলাপে লস অ্যান্ড ডেমেজের কথাটা উল্লেখ করেছেন। কপ-২৭-এ লস অ্যান্ড ডেমেজ নিয়ে একটা এজেন্ডা আছে। এ বিষয়ে আলোচনার একটা সুযোগ রয়ে গেছে। আমরা এটা নিয়ে কথা বলব। আমাদের কথা হচ্ছে, শুধু ১০০ বিলিয়ন ডলারে যথেষ্ট নয়।
তিনি বলেন, আমাদের লোকজন বাড়ি-ঘর হারাচ্ছে। বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে এ লস অ্যান্ড ডেমেজের কারণে। বড় বড় বেড়িবাঁধ ভাঙছে। বার বার আমাদের ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। সেজন্য লস অ্যান্ড ডেমেজের আলোচনা হওয়া খুব জরুরি। আমাদের দাবি হচ্ছে, ১০০ বিলিয়নের বাইরে আলাদা অর্থনৈতিক সুবিধা তৈরি করতে হবে।
লস অ্যান্ড ডেমেজ নিয়ে ইউরোপের অনেক দেশ কথা বললেও তারা এখনও আর্থিকভাবে নিশ্চয়তার বিষয়ে কথা বলছে অভিযোগ করে এ কর্মকর্তা বলেন, এটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থা এখনও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে ইউরোপের অনেক দশ কথা বলছে। তবে তারা এখনও আর্থিকভাবে কমিটমেন্ট করতে চাচ্ছে না। এটা নিয়ে জরুরিভাবে কথা বলা দরকার। এগুলো হচ্ছে, আমাদের জন্য মোটা-দাগে আগ্রহের জায়গা। সম্মেলনে আমরা এসব বিষয় তুলে ধরবো।
লস অ্যান্ড ডেমেজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাস্তুচ্যুতদের কথা সম্মেলনে তুলে ধরা হবে বলে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা এবং বন্যাসহ নানাবিধ কারণে যেসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব আন্তর্জাতিকভাবে দেখতে হবে। এ ব্যাপারে একটা সঠিক গাইডলাইন দরকার। বাংলাদেশের দিক থেকে এ বিষয়টা আমরা ইস্যু হিসেবে তুলতে চাই।
এর বাইরে আরও কিছু ইস্যু সম্মেলনে ঢাকার পক্ষ থেকে তোলা হবে জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, এছাড়া অভিযোজন ও প্রশমন, সবুজ প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টি আসবে। আমরা বলছি না প্রশমন জরুরি না। আমাদের মতো দেশের যেখানে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ এখনও অত্যন্ত কম, তারপরও আমাদের ওপর চাপ আছে কয়লাভিত্তিক রামপাল, পায়রা বা মাতারবাড়ি নিয়ে। আমাদের জন্য অভিযোজনটা বেশি জরুরি। দেখা যাচ্ছে, অভিযোজনে অর্থায়ন কমছে, প্রশমনে বাড়ছে। খরচের অধিকাংশ চলে যাচ্ছে প্রশমনে। কিন্তু অভিযোজন আমাদের জন্য বেশি দরকার। এ বিষয়গুলো আমরা তুলতে চাই।
সময় পেলে বাংলাদেশ আরও কিছু তুলে ধরার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, জলবায়ু ইস্যুতে বেসরকারি খাতকে সরকারি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। এটা কীভাবে হবে, সেটাও স্পষ্ট করা দরকার। জলবায়ু ইনস্যুরেন্সের কথা বলা হচ্ছে। এ রকম আরও নতুন নতুন কিছু বিষয় আসছে। সময় থাকলে আমরা এগুলো তুলব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু সম্মেলন একটি চলমান প্রক্রিয়া। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে যে সমস্যা তৈরি করেছে এ সম্মেলন সেসব সমস্যা সমাধানের পথকে জিইয়ে রাখার একটা বড় মাধ্যম। শীর্ষ নেতারা এ সম্মেলনে নতুন কী কী সিদ্ধান্ত নেন সেটার ওপর নজর থাকবে জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর। তাছাড়া উন্নত দেশগুলো জলবায়ু ইস্যুতে পুরনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে তাতে নজর থাকবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও স্ট্যামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুর্দীর্ঘ সময়ে কপ-২৬ পর্যন্ত যদি হিসাব করা হয় তাহলে কোনো একটি সম্মেলনে যেসব আলোচনা উঠেছে সবগুলো যে বাস্তবায়ন হয়ে গেছে বিষয়টা এমন নয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের যে সমস্যা সেটার সমাধানের পথটাকে জিইয়ে রাখার একটা প্রসেস হলো জলবায়ু সম্মেলন। বিশ্বের সব রাষ্ট্র প্রধানরা এ একটি সম্মেলনে একত্রিত হয়। বৈশ্বিক অন্য কোনো সমস্যা নিয়ে কিন্তু বিশ্বনেতারা এভাবে বসেন না।
কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, কপের একটা সফলতা হচ্ছে, যারা দায়িত্বশীল তারা কোথাও আলোচনা বসতে চায় না। কিন্তু এখানে যারা দায়িত্বশীল অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ বেশি করছে আবার ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলো তাদের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ পায়। উভয়পক্ষের বসার সুযোগটাকে আমরা প্রথম সাফল্য হিসেবে দেখতে চাই। দ্বিতীয়ত, আলোচনার টেবিলে যখন কোনো বিষয় থাকে সেটি সমাধানের একটা সম্ভাবনা থাকে। আলোচনা না করলে সমস্যা সমাধান হবে না, সেটা নিশ্চিত। কিন্তু আলোচনা করলে সমস্যা সমাধানের পথগুলো বের হয়ে আসে বা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাংলাদেশের কপ-২৭-এ যোগদান নিয়ে ক্যাপস প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক বলেন, ২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত উন্নত দেশেগুলো প্যারিস চুক্তির আওতায় প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। সেই ১০০ বিলিয়নে আমাদের হিস্যা কী হবে সেটি কিন্তু এখনও সুনির্দিষ্ট হয়নি। যে সমস্ত দেশ কম ক্ষতিগ্রস্ত তাদের হিস্যা কেমন, আর আমরা যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তাদের হিস্যা কেমন বা কী হবে, সে বিষয়ে আমাদের দাবি তুলতে হবে। আরেকটি হলো— আমাদের টোটাল যে ক্ষতি; লস অ্যান্ড ডেমেজে বিষয়টি আমরা বার বার করে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। কপ-২৬ এ আমরা তুলেছি। কিন্তু সফল হইনি। এবারও আমরা এটা তুলে ধরব। আমাদের সিত্রাং এবং সিলেটের বন্যার বিষয়টি এবার তুলে ধরার সুযোগ আছে। গত বারের চেয়ে আমরা বেশি তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে পারব।
মিশরে কপ সম্মেলন কতটা সফল হতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে পরিবেশবিজ্ঞানের এ অধ্যাপকের ভাষ্য, এবারের জলবায়ু সম্মেলন অন্যবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ। সম্মেলনের সফলতা কিছুটা হলেও আয়োজন রাষ্ট্রের শক্তিশালী ভূমিকার ওপরও নির্ভর করবে। অনেক সময় দেখা যায়, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর এজেন্ডার সঙ্গে যদি মিলে যায় দুর্বল রাষ্ট্রে সম্মেলন হলেও সেটি থেকে ভালো কিছু আশা করা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনে যাদের দায় আছে অর্থাৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো কি ধরনের ভূমিকা পালন করে সেটার ওপর নির্ভর করছে সফলতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারের কপ সম্মেলনে যাচ্ছেন না। এটি বাংলাদেশের সফলতার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে ক্যাপস প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক বলেন, প্রধানমন্ত্রী যেতে পারলে আমরা আরও শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে পারতাম। কিন্তু আশা করব, ওনার স্থলাভিষিক্ত হয়ে যারা যাচ্ছেন, তারা বাংলাদেশের বক্তব্য ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন।
কনফারেন্স অব দ্য পার্টিসের সংক্ষিপ্ত রূপ কপ। এটি বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিপর্যয় মোকাবিলায় জাতিসংঘের একটি উদ্যোগ। ১৯৯৫ সালে কপের প্রথম সম্মেলন হয়। ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিতে কপের জলবায়ু সম্মেলনে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ ইস্যুটি প্রথমবারের মতো সামনে আসে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। সবশেষ গত বছর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপের ২৬তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এনআই/এসএম