সব সমস্যা সমাধানের আশ্বাসে সর্বস্ব লুটে নিতেন ওয়াস কুরুনী
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে গোপন রোগের চিকিৎসা, প্রেমিক-প্রেমিকা বশীকরণের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার অভিযোগে ওয়াস কুরুনী (২৪) নামে ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার (২ নভেম্বর) সকালে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। কবিরাজ পরিচয় দেওয়া ওয়াস কুরুনী কুমিল্লার দক্ষিণ ইলিয়টগঞ্জের ভিকতলা নতুন বাড়ির মৃত শাহিদুল ইসলামের ছেলে।
র্যাব-৩ এর দাবি, গ্রেপ্তার ওয়াস কুরুনী ভণ্ড কবিরাজ। তিনি অর্ধশতাধিক লোকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার ও টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
ওয়াস কুরুনীকে গ্রেপ্তারের সময় একটি পাগড়ি, দুটি গলার হার, পাঁচটি গলার চেইন, দুই জোড়া কানের দুল, একটি মাথার টিকলি, মাথার চুল, পাঁচটি সাপ, চারটি বিভিন্ন মন্ত্র লেখা কাগজ, একটি তাবিজের খোসা, কাঠের দুটি লাঠি, দুটি হরিণের চামড়া, বিভিন্ন ধরনের বনজ গাছ, চারটি শিঙ্গা, দুটি বড় কড়ি, পাঁচটি ছোট কড়ি, তিনটি হাড়ের টুকরা, একটি মরিয়ম ফুল ও একটি মোবাইল জব্দ করা হয়েছে।
বুধবার দুপুরে র্যাব-৩ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া ওয়াস কুরুনীর কবিরাজ আলী আশরাফ, তান্ত্রিক কবিরাজ ও হুমায়ুন আহমেদ নামে তিনটি বেনামি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে তিনি মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের চিরাচরিত সমস্যা যেমন, উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের গোপন রোগের চিকিৎসা, দাম্পত্য জীবনের সমস্যা, বিয়ে না হওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, চাকরি না পাওয়া, জমি-জমার ঝামেলা, কাউকে বশ করার প্রবণতা, বাণ মারার শক্তিশালী মন্ত্র, মামলায় জয়ী হওয়ার মন্ত্র, বিবাহের প্রস্তাব আসার তাবিজ, প্রেম সফল করার তাবিজ, বিয়ে বন্ধ করার তাবিজ, মানুষকে পাগল করার তাবিজসহ নানা শিরোনামে বিভিন্ন পোস্ট করতেন।
ওয়াস কুরুনীর ২০ থেকে ২২ জন নির্বাচিত এজেন্ট রয়েছেন, যাদের কাজ হলো পোস্ট বারবার শেয়ারের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া এবং আগ্রহীদের প্রতারণার শিকার বানিয়ে তাদের কাছ থেকে ছলে-বলে-কৌশলে মোটা অঙ্কের টাকা ও হাদিয়া হিসেবে স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নেওয়া। ওয়াস কুরুনী বিকাশ নম্বরে অর্থের লেনদেন করতেন এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভুক্তভোগীদের স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নিতেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের (১৫-২০ বছর বয়সী) টার্গেট করে তার নিয়োগকৃত নারী এজেন্টরা বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয় এবং মহিলা মাদ্রাসায় গিয়ে অপেক্ষমাণ অভিভাবকদের সাথে মিশে যেতেন এবং সেখান থেকে বিভিন্ন মেয়েদের টার্গেট করেন। অভিভাবক পরিচয়ে তারা স্কুল পড়ুয়া অল্পবয়সী মেয়েদের বিভিন্ন গোপন সমস্যা নিয়ে কথা বলে সেসব সমস্যা কবিরাজি চিকিৎসা ও তাবিজ নেওয়ার মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে তাদের প্রলুব্ধ করতেন।
তাদের প্রলোভনে পড়ে ভুক্তভোগীরা জমানো টাকা, অলংকার ও পারিবারিক যেকোনো মূল্যবান সম্পদের বিনিময়ে হলেও সমস্যা সমাধানের জন্য যোগাযোগ করলে সহযোগীরা (এজেন্ট) কবিরাজ ওয়াস কুরুনীর মোবাইল নম্বর দিতেন। তখন তিনি তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাদের কাছ থেকে অর্থ এবং স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে নিতেন।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার ওয়াস কুরুনীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৩ সিও বলেন, টার্গেট করা নারী ও পুরুষ ভুক্তভোগীদের সঙ্গে ওয়াস কুরুনী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে চ্যাটিং ও ভয়েস কলের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিতেন। প্রাথমিকভাবে তিনি জিন চালনার মাধ্যমে ওষুধ দেওয়া এবং গায়েবি চিকিৎসা শুরু করার জন্য দুর্লভ কিছু উপাদান যেমন কচি কবুতরের রক্ত, ইঁদুরের মাংস, বানরের লোম, বাদুরের পা, গভীর রাতে শ্মশানঘাট থেকে মাটির কলসিতে পানিসহ দুষ্প্রাপ্য জিনিস সংগ্রহ করতে বলতেন।
তখন ভুক্তভোগীরা জানান, এসব জিনিস তাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। তখন তিনি এসব জিনিস সংগ্রহ করার বদলে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতেন। ভুক্তভোগীরা বাধ্য হয়ে তাকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা দিতেন। তার চিকিৎসায় কাজ না হওয়ার বিষয়ে রোগীরা অভিযোগ দিলে বা আরও ত্বরান্বিত চিকিৎসা চাইলে জিনের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার জন্য জিনকে উপহার দেওয়ার কথা বলে সুকৌশলে স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তার নিকট পাঠাতে বলতেন। বিশ্বাস অর্জনের জন্য তিনি কবিরাজির বিভিন্ন ছবি এবং ভিডিও ধারণ করে ভুক্তভোগীদের কাছে পাঠাতেন। তার কাছ থেকে জব্দ করা মোবাইলে এরকম অসংখ্য ছবি এবং ভিডিও পাওয়া যায়।
কেউ তার প্রতি অবিশ্বাস বা সন্দেহ প্রকাশ করলে দুষ্ট জিনের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে তাদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে বলে হুমকি দিতেন। এভাবে ধাপে ধাপে ভয় দেখিয়ে বিকাশের মাধ্যমে টাকা নিতেন। তবে তিনি কখনোই ভুক্তভোগীদের সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন না। নারী ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অধিক অর্থ আদায়ের জন্য তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখাতেন। এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে তিনি এবং তার পুরো চক্র মিলে গত তিন বছরে অর্ধশতাধিক লোকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নিয়েছেন।
র্যাব-৩ অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন বলেন, স্বর্ণালংকার ও আত্মসাৎ করা অর্থ দিয়ে এই ভণ্ড কবিরাজ লৌহজং এলাকায় জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেছেন। অর্থ ও স্বর্ণালংকার নেওয়ার পর প্রতারিতদের ফোন নম্বর তিনি এবং তার এজেন্টরা মোবাইল থেকে ব্লক করে দিতেন, যাতে কেউ যোগাযোগ করতে না পারেন। এরপর ভুক্তভোগীরা তাদের দেওয়া অর্থ ও অলঙ্কার ফেরত পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
ওয়াস কুরুনী মাদ্রাসা থেকে হেফজখানা পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। তিনি ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে কবিরাজি পেশা শুরু করেন। প্রথমে তিনি যাত্রীবাহী বাসে তাবিজ বিক্রি ও বশীকরণের বই বিক্রি করতেন। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেনামি অ্যাকাউন্ট চালিয়ে এবং বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে নিরীহ সহজ-সরল সমস্যাগ্রস্ত বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ ও স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ শুরু করেন।
র্যাব জানায়, ওয়াস কুরুনীর দৃশ্যমান কোনো পেশা নেই। প্রতারণাই তার পেশা। তিনি চাড় বছর আগে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং এলাকায় বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করছিলেন। প্রতারণার কাজে তার স্ত্রী তাকে সহায়তা করে আসছিলেন। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
জেইউ/আরএইচ