কেবল জরিমানায় আটকে আছে বিআরটিএ, পরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরাবে কে?
বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয় চলতি বছরের আগস্টের ৫ তারিখে। পরের দিন বাস মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এক বৈঠকে বাসভাড়া বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। যা সারাদেশে কার্যকর হয় ৭ আগস্ট থেকে। ওই দিন থেকেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু করে বিআরটিএ।
নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ফলে ভাড়া নৈরাজ্য কমেছে বলে দাবি সংস্থাটির। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ অভিযান’ বলছে যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। আর পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনবহুল ঢাকা শহরে গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরানো অনেক কঠিন।
বিআরটিএর তথ্য বলছে, শুধু অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অপরাধে গত ৭ আগস্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে ৬২২টি মামলার বিপরীতে বিভিন্ন গণপরিবহন থেকে ২৫ লাখ ৭৭ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
একই সময়ে রুট ভায়েলেশন/রুট পারমিট না থাকা, ওয়েবিল চালু রাখা, হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো, ফিটনেসবিহীনগাড়ি চালানোসহ অন্যান্য অপরাধের দায়ে ২ হাজার ২৩৪টি মামলা দিয়ে ৪৪ লাখ ৫৪ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে বাস চালানোর সঙ্গে জড়িত ১৭ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, ৪৫টি বাসকে ডাম্পিং করা হয়েছে।
এতকিছুর পরও গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছে। যাত্রীরা বলছেন, যখন অভিযানের কথা শোনা যায় তখনই কেবল কিছুটা শান্ত থাকার চেষ্টা করে চালক-হেল্পাররা। অভিযান শেষ হলে তারা আবার পুরোনো রূপে ফিরে আসে। অতিরিক্ত ভাড়াসহ নানা ধরনের নতুন নিয়ম তৈরি করে তারা।
জাহিদ আহসান নামে রাজধানীর এক বাস যাত্রী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ধানমন্ডির শংকর থেকে নিউমার্কেট রুটে নিয়মিত যাতায়াত করি ১৩ নম্বর বাসে। ভাড়া বাড়ানোর আগে এ পথের ভাড়া ছিল ৮ টাকা। ভাড়া বৃদ্ধির পর হয়েছে ১৫ টাকা। এক লাফে বেড়েছে ৭ টাকা। বাসগুলোর কোনোটিরই ফিটনেস নেই। রাতে এসব বাসে বাতি পর্যন্ত নেই। ভাড়া নেওয়ার সময় সরকারি রেট, আর সার্ভিস দেওয়ার সময় মাকাল ফল। এই পথে কখনো বিআরটিএকে অভিযান পরিচালনা করতে দেখিনি।
আরও পড়ুন : পার্সেন্টেজ নয়, ‘ভাড়া সমন্বয়’ চান বাস মালিকরা
জানা গেছে, ৭ থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত ১৫ দিনে রাজধানীতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ নানা অপরাধে সবচেয়ে বেশি মামলার শিকার হয়েছে উত্তরা থেকে যাত্রাবাড়ী রুটে চলাচলকারী রাইদা এন্টারপ্রাইজ। রাইদার মামলা সংখ্যা ১৬টি।
জানতে চাইলে রাইদা এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মকবুল হোসেন পাটোয়ারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য তাদের কার্যক্রমে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। যদি কোনো অন্যায় হয়, জরিমানা করবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা বাস মালিকদের তো বলি না যে আপনারা যথাযথ কাগজপত্র ছাড়া রোডে বাস নামান, যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেন। যারা এটা করে তাদের জরিমানা করা হয়। আমি কোনোভাবেই এর বিপক্ষে নই।
তিনি বলেন, আমাদের যেসব গাড়ির কাগজপত্রে ঝামেলা ছিল বা যাদের রুট পারমিট শেষ হয়ে গেছে তারা এখন আর গাড়ি চালাচ্ছেন না।
এ প্রসঙ্গে যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিআরটিএর মূল কাজ জরিমান আদায় করা নয়, মূল কাজ হলো সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো। একদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত চলছে, অন্যদিকে ভাড়া বৃদ্ধি হচ্ছে। বর্তমানে যে বাস ভাড়া, তা সাধারণ যাত্রীদের জন্য কষ্টকর হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় যখন সরকারের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়, তখন প্রত্যাশা থাকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ভাড়া কমে আসবে। বিআরটিএ এমন নজির হাজির করুক যেখানে আগে ২০ টাকা ভাড়া নেওয়া হতো অভিযানের পর সেটি কমে ১০ টাকা হয়েছে। কিন্তু এসব না করে তারা সারাদিন বলে, আজ তিন লাখ টাকা জরিমানা হয়েছে, কাল দুই লাখ টাকা জরিমানা হয়েছে, পরশু ৪ লাখ টাকা জরিমানা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তিনি বলেন, বিআরটিএতে বিভিন্ন সময় আমি বলেছি, আপনাদের অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা প্রশ্নবিদ্ধ অভিযান চাই না। আমরা জানতে চাই, অভিযানের আগের পরিবেশ কেমন ছিল এবং অভিযানের পরে কী পরিবর্তন হয়েছে সেটা আপনারা সবাইকে জানান। কিন্তু তা না করে বিআরটিএ বরাবরই জরিমানা আদায়কে সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরছে। আর মালিক সমিতিকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান পরিচালনার মধ্য দিয়ে কী ফায়দা হয়েছে আমার জানা নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাসের বিরুদ্ধে জরিমানা করা সেটা আলাদা বিষয়। সেটার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে এভাবে জরিমানা করে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে না।
তিনি বলেন, ঢাকা শহরে যে বাসগুলো চলে তার মধ্যে ৭০ শতাংশ বাসের ইঞ্জিনের সক্ষমতা পার হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বাসের ফিটনেস নেই। এমনকি যেগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে সেগুলোর আসলে কতখানি ফিটনেস আছে সেটাও দেখার বিষয়। কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফিটনেস দেওয়া হয়, এটি সবাই জানি। চোখে দেখলেই বুঝা যায় গাড়ি আনফিট। রোড পারমিট দেওয়ার বিষয়েও বিস্তর অভিযোগ আছে। রোড পারমিটগুলো বৈজ্ঞানিক ওয়েতে দেওয়া হয় না।
হাদিউজ্জামান বলেন, এসব জায়গায় বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত করে কোনো লাভ হবে না। এর জন্য ব্যাপক সংস্কার দরকার। আর সংস্কার শুরু হতে হবে বিআরটিএ থেকেই। সংস্কারটা এখান থেকে শুরু করতে হবে, কারণ ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেস দিচ্ছে বিআরটিএ।
রুট পারমিট কমিটিতে পরিবহন বিশেষজ্ঞ রাখা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, শুধু পদাধিকার বলে কেউ একজন রুট পারমিট কমিটির সদস্য হয়ে যাবেন এটা হতে পারে না। ঢাকার মতো এরকম জনবহুল জায়গায় যারাবিষয়গুলো বোঝেন, তাদেরকেই ওই কমিটিতে রাখতে হবে। না হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। আসলে সড়কে বিশৃঙ্খলা এতটাই জটিল আকার ধারণ করেছে যে, নিয়মের মধ্যে আনতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
আরও পড়ুন : ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ চলছে ২ হাজারের বেশি লেভেল ক্রসিং
ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় কতটা সফল বিআরটিএ- এমন প্রশ্নে সংস্থাটির উপপরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. হেমায়েত উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অবশ্যই আমরা সফল। কারণ, আমাদের কঠোর ইন্সট্রাকশন ছিল তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর কেউ যেন ভাড়া নৈরাজ্য করতে না পারে তার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা। যখন তেলের মূল্য বৃদ্ধি পায় তখন আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা রাজধানীতেই ৪০ থেকে ৫০টি গাড়ির বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পেয়েছে। যা এখন ৮-১০টিতে নেমে এসেছে। জরিমানার ফলেই এসব পরিবর্তন এসেছে।
এমএইচএন/ওএফ