আমি বিদায় নিতে প্রস্তুত : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগের একজন কাউন্সিলরও যদি বলে আমাকে চায় না, আমি নেতৃত্বে থাকব না। দীর্ঘদিন তো হয়ে গেছে, অবশ্যই আমি চাই নতুন নেতৃত্ব আসুক। কাউন্সিলররাই নেতৃত্ব ঠিক করে, তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, আমরা একটানা ক্ষমতায় ছিলাম বলে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। এখন বিদায় নেওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত।
বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার যাওয়ার আসলে সময় হয়ে গেছে। তিনি বলেন, জাতির পিতা বাংলাদেশ স্বাধীন করে একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করে স্বল্প-উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জন করে দিয়ে যান। জাতিসংঘ এর স্বীকৃতি দিয়েছিল। এরপর এ দেশে কী ঘটেছে? গণতন্ত্র ছিল না, তার পরিবর্তে ছিল মিলিটারি শাসন। অনেক চড়াই উৎরাই পার করে আমরা গণতন্ত্র উদ্ধার করি। একটানা ৩ বার, ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ২০২২ সাল পর্যন্ত, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম একটানা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে।
তিনি আরও বলেন, এর মাঝে অনেক চড়াই উৎরাই, খুন খারাবি, অগ্নি সন্ত্রাসসহ নানা কিছু ঘটেছে। তারপরও আমরা একটানা ক্ষমতায় ছিলাম বলে উন্নয়নশীল দেশে আমারা উন্নীত হয়েছি। এখন বিদায় নেওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত।
ভোট চুরি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে না
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ কখনো ভোট চুরি করে ক্ষমতায় আসবে না বা আসেওনি। আওয়ামী লীগ কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন হলো যেকোনো রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত। কে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, কে করবে না, সেখানে আমরা কিছু চাপিয়ে দিতে পারি না। রাজনীতি করতে হলে দলগুলো নিজে সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা অবশ্যই চাই সব দল অংশগ্রহণ করুক। আমরা চাই সব দল আসুক, নির্বাচন করুক।
সরকারপ্রধান বলেন, এতদিন কাজ করার পর নিশ্চয়ই আমরা চাইব যে, সবাই আসুক। গতবার যে সবার সঙ্গে বৈঠক করলাম, নির্বাচনে এসে দেখা গেল ৩০০ সিটে ৭০০ নমিনেশন নিয়ে যখন নিজেরা হেরে গেল তখন সব দোষ আওয়ামী লীগের!
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আওয়ামী লীগ কখনো কোনো মিলিটারি ডিক্টেটরের পকেট থেকে বের হয়নি। ইমার্জেন্সি দিয়ে ক্ষমতা দখল করেও কিন্তু আওয়ামী লীগ কখনো ক্ষমতায় আসেনি। আওয়ামী লীগ যতবার ক্ষমতায় এসেছে, ভোটের মাধ্যমেই এসেছে, নির্বাচনের মাধ্যমেই এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ দেশে নির্বাচনে যতটুকু উন্নতি, যতটুকু সংস্কার এটা আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সবাইকে নিয়ে করেছি। এরপরও যদি কেউ না আসে, সেখানে আমার কী করণীয়? হারার ভয়ে তো আসব না বা একেবারে সবাইকে লোকমা তুলে খাইয়ে দিতে হবে, তবে আসব; এটা তো আর হয় না।
বিএনপিকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, তারা তো জনগণের কাছে যেতে ভয় পায়। জনগণের সামনে ভোট চাইতে গিয়েও ভয় পায়। এটা হলো বাস্তবতা। অগ্নিসংযোগ করে যারা মানুষ হত্যা করেছে, তাদের কি মানুষ ভোট দেবে? কখনো দিতে পারে না। কারণ সেই পোড়া ঘা তো সবার শুকায়নি। এখনো কষ্ট পাচ্ছে, গ্রেনেড হামলায় যারা আহত।
র্যাবের নিষেধাজ্ঞা ও গুম প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী
র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে, র্যাব সৃষ্টি করেছে কে? র্যাব সৃষ্টি তো আমেরিকারই পরামর্শে। আমেরিকা তাদের ট্রেনিং দেয়, অস্ত্রশস্ত্র দেয়। এমনকি তাদের ডিজিটাল সিস্টেম, আইসিটি সিস্টেম সবই আমেরিকার দেওয়া। আমেরিকা যখন নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখন একটাই কথা যেমন আপনারা ট্রেনিং দিয়েছেন, তেমন তারা কার্যক্রম করেছে। এতে আমাদের করার কী আছে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সে র্যাব হোক, পুলিশ হোক কিংবা আর্মি হোক, কেউ যদি কোনো অপরাধ করে তার কিন্তু বিচার হয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখেছি, পুলিশ ইচ্ছামতো গুলি করে মারলেও তাদের কিন্তু কোনো বিচার হয় না। একটা ছোট বাচ্চা পকেটে হাত দিল, তাকেও গুলি করে মেরে ফেলে দিল। আমেরিকার লোক সবাই যখন আন্দোলনে নামলো, তখন ওই একটাই বিচার মনে হয় সারা জীবনে করতে পেরেছে। আমাদের কতজন বাঙালি সেখানে মারা গেছে, সে কথা কিন্তু তারা বলে না। সে কথা আমি তাদের বলেছি।
তিনি বলেন, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’, আমরা এই নীতিতে বিশ্বাস করি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সময়ে সময়ে আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এটা সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক যে, আমাদের দেশের কিছু লোক তাদের সিনেটরসহ বিভিন্ন জায়গায় নানা মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকে। দেশের বদনাম করে তারা। যারা এমনটা করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে নিজেরা একেকটা অপকর্ম করে দেশ ছেড়েছে বা চাকরিচ্যুত।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, আরও কয়েকটি দেশে এমন মানুষ রয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী যাদের ফাঁসি আমরা দিয়েছি, তাদের সন্তানরাও এসব দেশে রয়েছে। স্বাধীনতার পরে ২১ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল, বাংলাদেশকে শোষণ করে অর্থ পাচার করে নিয়ে গেছে সেসব দেশে। তারাই অপপ্রচার চালাচ্ছে দেশের বিরুদ্ধে।
সরকারপ্রধান বলেন, নিষেধাজ্ঞা তারা কবে তুলবে জানি না। তবে, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তারা ক্ষতি যেটুকু করেছে, যাদের দিয়ে আমরা এদেশের সন্ত্রাস দমন করেছি, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার অর্থটা কি? সন্ত্রাসীদের মদদ দেওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আমার এটাও প্রশ্ন, তাহলে কি সন্ত্রাস দমনে তারা নাখোশ?
তিনি বলেন, ৪০ বছর ধরে তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আবার সেই তালেবানদের হাতেই আফগানিস্তানের ক্ষমতা দিয়ে চলে আসলো আমেরিকান সৈন্যরা। নিজেদের ব্যর্থতার কথা তারা বলে না তো। এখন আবার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তো সাধারণ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে। কথায় কথায় একটা দেশের বিরুদ্ধে আরেকটা দেশ নিষেধাজ্ঞা দেয়, এটা কেমন কথা! আমি আমার বক্তৃতায় এটা স্পষ্ট করে বলে আসছি। এটা বলেছি, এই যুদ্ধ কিন্তু থামাতে হবে।
গুম-খুনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থার অভিযোগের বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, কয়েকটা আন্তর্জাতিক সংস্থা গুম-খুন নিয়ে কথা তুলল। গুমের হিসেব যখন বের হতে শুরু করলো, তখন তো দেখা গেলো সবচেয়ে বেশি গুম জিয়াউর রহমানের আমলেই শুরু। তারপর থেকে তো চলছেই। আমরা যখন তালিকা চাইলাম, ৭৬ জনের তালিকা পাওয়া গেল। এর মধ্যে কি পাওয়া গেল আপনারা নিজেরাই তো ভালো জানেন। আমাদের দেশে এমনও আছে, আরেকজনকে শায়েস্তা করতে মা-কে লুকিয়ে রেখে গুম-খুনের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ কখনো ঋণ খেলাপি হয়নি
অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ কখনো ঋণ খেলাপি হয়নি। আমরা যথা সময়ে ঋণ পরিশোধ করে দিই। আর যখন আমরা ঋণ পরিশোধ করি তখন রিজার্ভ কিছুটা কমে যায়। তারপরও পাঁচ মাসের খাদ্য কেনার মতো রিজার্ভ আমাদের আছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা যেন থাকে তার জন্য যা যা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার আমরা নিচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্ব নেতৃত্ব, যাদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, তারা সবাই আশঙ্কা করে বলছেন, ২০২৩ সালে বিশ্বের জন্য একটি অত্যন্ত দুর্যোগময় সময় এগিয়ে আসছে। এমনকি বিশ্বে দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন আমাদের দেশ এমনিতেই দুর্যোগপ্রবণ। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যদিকে মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ। এসব দুর্যোগ আমাদের মোকাবিলা করতে হয়। এসব মোকাবিলা করেও তিন মেয়াদে আমরা দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি সবাইকে আহ্বান জানিয়েছি, যার যে জমি আছে সবাই যেন সেখানে কিছু না কিছু উৎপাদন করে। বিশ্বব্যাপী একটি আশঙ্কা আছে, আগামী বছর একটি মহাসংকটের বছর হবে, তাই আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। বিদ্যুৎ, পানি, খাদ্য ব্যবহারে যেন সবাই সচেতন হই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামীর কথা চিন্তা করে কীভাবে আমরা সাশ্রয়ী হব, কী কী কাজ করতে হবে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা আছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা আমাদের অর্থনীতি সচল রাখতে পেরেছি এটাই হলো বাস্তবতা।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে টানা ১৮ দিনের সফর শেষে গত ৩ অক্টোবর দেশে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে যান তিনি। সেখানে তিনি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেন। পরে ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি নিউইয়র্কের উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের সময় ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। পরে ওয়াশিংটনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি।
এএসএস/এসএম/জেএস