ঘুষসহ শিক্ষা কর্মকর্তাকে ধরিয়ে দিয়ে বিপাকে অন্তঃসত্ত্বা শিক্ষিকা
তাসলিমা আকতার। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ফরহাদাবাদ নূর কাজী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এ শিক্ষিকা আছেন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। ‘জনতার শক্তি, রুখবে দুর্নীতি’ দুদকের এমন স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাসলিমা ঘুষসহ হাতেনাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে। এমন সাহসী পদক্ষেপের জন্য তাৎক্ষণিক বাহবা পেলেও এখন হয়রানির শিকার হচ্ছেন তিনি। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে দুদকে চিঠি পাঠিয়েছেন তাসলিমা আক্তার।
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুদকের একটি টিম ফাঁদে ফেলে ফটিকছড়ি উপজেলা শিক্ষা অফিসার আজিমেল কদরকে ঘুষের ১০ হাজার টাকাসহ গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় মামলা ও চার্জশিট হয়। একই সঙ্গে ওই শিক্ষা অফিসারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দুদকের মামলাটি এখন সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।
কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, দুদক দুর্নীতির সত্যতা পেলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘুষ গ্রহণের অভিযোগের সত্যতা পায়নি। শুধু তাই নয়, তারা শিক্ষা কর্মকর্তা আজিমেল কদরকে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। পাশাপাশি অভিযোগকারী শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অসম্মানিত করার অভিযোগ এনে বিভাগীয় মামলা করার আবেদন করেছেন। একইসঙ্গে তাসলিমাকে শোকজ নোটিশও দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় চরম হতাশা ও মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন ভুক্তভোগী শিক্ষিকা তাসলিমা আকতার।
এ বিষয়ে তাসলিমা আকতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাকে (অভিযুক্ত শিক্ষা কর্মকর্তা) বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সেটা শিক্ষা অফিসের বিষয়। এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ ঘুষসহ হাতে-নাতে গ্রেপ্তারের মামলা ইতোমধ্যে চার্জশিটও হয়েছে। কিন্তু কথা হলো, আমাকে কেন হয়রানি করা হচ্ছে? এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেছি আমি।
তিনি বলেন, শিক্ষা অফিসার আজিমেল কদরকে ঘুষসহ গ্রেপ্তারের তিন বছর পর কেন আমাকে হয়রানি করা হচ্ছে? আমার কাছে ঘুষের রেকর্ডিংসহ নানা তথ্য-উপাত্ত চাচ্ছে। কিন্তু আমি দুদকে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি। ওই সময় দুদকের কর্মকর্তাদের রেকর্ডিং শুনিয়েছিলাম। তারা আমাকে সংরক্ষণ করতে বলেননি, তাই আমি তা রাখিনি। কিন্তু ঘটনা প্রমাণিত সত্য। এখন তারা আমাকে বরখাস্তের হুমকি দিচ্ছে। বর্তমানে আমি ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, মার্তৃত্বকালীন ছুটিতে আছি। এ অবস্থায় এ ধরনের হয়রানি সহ্য করা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমি শিক্ষা অফিসের এসব অপ-তৎপরতা বন্ধ চাই এবং যারা হয়রানি করছে তাদের বিচার চাই।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ’র কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাছে প্রতিকার চেয়ে কোনো আবেদন এখন পর্যন্ত আসেনি। যদি আমার কাছে আসে, আমি অবশ্যই এ বিষয়টি দেখব।
আরও পড়ুন: ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ভূমি অফিসের নাজির বরখাস্ত
উপজেলা শিক্ষা অফিসারের ঘুষকাণ্ড
তাসলিমা আকতার উপজেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ৩টি স্কুলের নাম উল্লেখ করে বদলির জন্য আবেদন করেন। এরপর ওই বছরের ২০ মার্চ বদলির বিষয়ে জানার জন্য ফটিকছড়ি উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে গেলে তিনি ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। নিজেকে গরিব দাবি করে আকুতি-মিনতি করলে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা ঘুষ না হলে বদলি করবেন না বলে জানান শিক্ষা অফিসার। তার কথায় রাজি হয়ে বদলির ফাইল রেডি করতে বলেন শিক্ষিকা।
এরপর দুদকের চট্টগ্রাম অফিসকে বিষয়টি অবগত করে অভিযোগ দায়ের করেন তাসলিমা। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ চট্টগ্রাম -১ এর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ লুৎফুল কবির চন্দনের নেতৃত্বে দুদকের একটি টিম ফটিকছড়ি উপজেলা শিক্ষা অফিসার আজিমেল কদরকে ঘুষের ১০ হাজার টাকাসহ হাতে-নাতে গ্রেপ্তার করে। ওই দিনই দুদকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-সহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে ফটিকছড়ি থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ওই ঘটনায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে মামলাও করা হয়। তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৬১ ধারা ও ১৯৪৭ সনের ২ নং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় মামলা দায়ের করেছিল দুদক।
দুদকের কাছে ভুক্তভোগী নারীর আবেদনে যা বলা হয়েছে
দুদকের কাছে প্রতিকার চেয়ে করা আবেদনে তাসলিমা আকতার বলেন, দীর্ঘ তদন্ত শেষে ওই ঘুষকাণ্ডের মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক। মামলাটি বর্তমানে চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। মামলাটি আদালতে চলমান থাকা অবস্থায় উপজেলা শিক্ষা অফিসার আজিমেল কদরের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। সম্প্রতি আজিমেল কদরকে ওই মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।
এর পরপর আজিমেল কদর আমার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। ওই অভিযোগে আজিমেল কদর আমাকে দায়ী করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অসত্য ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত অভিযোগ দায়ের করে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩ (খ) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধের বিভাগীয় মামলা রুজু করার দাবি করেন। অপরদিকে অভিযোগ নামায় একই বিধিমালার ৪ ধারা মোতাবেক কেন আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
আবেদনপত্রে ভুক্তভোগী শিক্ষিকা আরও বলেন, আমি বর্তমানে ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছি। ফলে আমি মানসিক ও শারীরিকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি। আমি গরিব হলেও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি। আমি আমার বদলির জন্য কোন ঘুষ দিতে চাইনি। আমি মনে করি, দুদকে অভিযোগ করার কারণেই আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়েছে। দুদকে অভিযোগ করায় একজন নিরীহ শিক্ষককে যদি হয়রানির শিকার হতে হয় কিংবা চাকরিচ্যুত হতে হয়, তাহলে কেউ আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে না।
এ বিষয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর উপ-পরিচালক মো. নাজমুস সাদাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা আবেদন পাওয়ার পরপর তা দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা খতিয়ে দেখবেন।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খানের সই করা আদেশে চট্টগ্রামের সেই আলোচিত ফটিকছড়ির শিক্ষা কর্মকর্তা আজিমেল কদরকে বিভাগীয় মামলায় ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ওই আদেশে বলা হয়, মো. আজিমেল কদরের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী ( শৃঙ্খলা ও আপিল ) বিধিমালা , ২০১৮ এর বিধি ত (খ ) ও ( ঘ ) অনুযায়ী অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগে গত ২ সেপ্টেম্বর দায়ের করা বিভাগীয় মামলা পরিচালনা করার মতো উপযুক্ত ভিত্তি না থাকায় তাকে অব্যাহতি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আজিমেল কদর লিখিত জবাব দাখিল করেন এবং ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন। তার লিখিত জবাব, শুনানিতে প্রদত্ত বক্তব্য এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় বিভাগীয় মামলাটি তদন্তে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি বিধায় তদন্তকারী কর্মকর্তা মতামতের ভিত্তিতে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে আদেশ বলা হয়েছে।
এরপর আজিমেল কদরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভুক্তভোগী শিক্ষিকা তাসলিমা আকতারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চালু করে চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় থেকে চিঠি ইস্যু করা হয়।
আরএম/এসকেডি