বাবুলের কথায় ৩ লাখ টাকায় কিলিং মিশনে নামেন ৬ জন
সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তে পাওয়া তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগপত্রও তৈরি করা হয়েছে। খুব শিগগির আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে। তদন্তে উঠে এসেছে, বাবুলের পরিকল্পনা ও অর্থায়নে মিতুকে খুন করা হয়েছে। স্ত্রীকে খুন করতে বাবুল খুনিদের ৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। কিলিং মিশনে ছিলেন ৬ জন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মামলার সাক্ষ্য স্মারকে (এমওই) সই করেছেন।
অভিযোগপত্রে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। বাকি ছয় আসামি হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু ও শাহজাহান মিয়া।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিতু হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ঢাকা থেকে অনুমোদন পেলেই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে। আশা করছি শিগগিরই এটি করতে পারব। তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পেরেছি, বাবুল আক্তারের পরিকল্পনা ও অর্থায়নেই মিতুকে হত্যা করা হয়েছে।
তদন্তে পাওয়া গেছে হত্যার সময় কিলিং মিশনে ছয় ব্যক্তি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। একজন অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। বাবুল আক্তার তার স্ত্রীকে খুন করতে খুনিদের ৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। খুনের মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাবুলের ‘সোর্স’ মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত বিদেশি নাগরিক এক নারীর সঙ্গে বাবুলের পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়া নিয়ে তাদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়। এর জেরে বাবুল আক্তার স্ত্রীকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম (মিতু)। এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মামলায় অভিযোগ করেন তিনি। তবে দিন যত গড়িয়েছে মামলার গতিপথও পাল্টেছে। এক পর্যায়ে সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে বাবুল আক্তারের নাম। তদন্তে তার বিরুদ্ধেই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে হেফাজতে নেয় পিবিআই।
পরে গত বছরের ১২ মে বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করে নতুন করে মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় বাবুল আক্তারকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। রিমান্ড শেষে প্রথমে আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার কথা থাকলেও পরে জবানবন্দি দেননি বাবুল। পরে তাকে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়।
চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি মিতু হত্যার ঘটনায় তার বাবা মোশাররফ হোসেনের দায়ের করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে পিবিআই। সংস্থাটি জানায়, একই ঘটনায় বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার তদন্ত এগিয়ে নিতে মিতুর বাবার মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। একই ঘটনায় দুটি মামলা চলতে পারে না। সম্প্রতি আদালত এটিকে ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করেন। তাই আদালতের পর্যবেক্ষণ মেনে ও বিধিবিধান অনুসারে মিতুর বাবার দায়ের করা মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, বাবুলের করা মামলাটির অধিকতর তদন্ত চলবে।
মিতু হত্যার ঘটনায় দুটি মামলাই তদন্ত করছেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক। এর মধ্যে বাবুল আক্তারের করা মামলাটির অধিকতর তদন্ত চলছে। অধিকতর তদন্ত চলাকালে আদালতের আদেশে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি বাবুল আক্তারকে নিজের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, মিতু হত্যার ঘটনায় বাবুল আক্তার যে মামলাটি দায়ের করেছিলেন, সেটির তদন্ত শেষ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল পিবিআই। কিন্তু আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন না নিয়ে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন।
মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন তার মামলায় অভিযোগ করেছিলেন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত বিদেশি নাগরিক গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন বাবুল আক্তার। বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর মিতুর সঙ্গে বাবুলের সম্পর্কের অবনতি হয়। এর জেরে বাবুল পরিকল্পিতভাবে লোক ভাড়া করে মিতুকে খুন করান। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তদন্তে মোশাররফের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পিবিআই।
মামলার আলামত হিসেবে উপহার পাওয়া বাবুল আক্তারের একটি বই জব্দের পর হত্যাকাণ্ডের জট খোলে। গায়ত্রী বাবুলকে আহমেদ রশিদ রচিত ইংরেজি ভাষার ‘তালিবান’ নামে একটি বই উপহার দেন। ওই বইয়ের তৃতীয় পাতায় গায়ত্রী অমর সিংয়ের নিজের হাতের লেখা এবং শেষ পাতার পরের খালি পাতাটিতে বাবুল আক্তারের হাতে লেখা ইংরেজিতে তাদের ‘প্রথম সাক্ষাতের’ বিষয়সহ কিছু তথ্য লেখা আছে।
গত ৭ মার্চ তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে বাবুল আক্তারের হাতের লেখার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে পিবিআই নিশ্চিত হয় যে, বইয়ের পাতায় লেখাগুলো বাবুল আক্তারেরই।
পিবিআই পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, বিভিন্ন জনের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই, মামলার বিভিন্ন আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছি। সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় মিতু খুনের পর গ্রেপ্তার হওয়া চারজনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এ মামলায় বাবুল আক্তার, ওয়াসিম, শাহজাহান মিয়া ও আনোয়ার হোসেন কারাগারে আছেন। আর ভোলাইয়া জামিনে আছেন। আর হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই নিখোঁজ আছেন কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসা।
কেএম/ওএফ