ছোট্ট ঘরের এক পাশে গরু, অন্য পাশে চা-শ্রমিকের পরিবার
সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কাছে মালনীছড়ায় বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪৯ সালে। তখন এ দেশ ছিল ব্রিটিশদের অধীনে। ব্রিটিশরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে প্রচুর শ্রমিক নিয়ে আসে চা বাগানের কাজের জন্য। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সনাতন ধর্মাবলম্বী শ্রমিকরা চা শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তানি শাসন, তারও পরিসমাপ্তি হয়েছে ৫০ বছর আগে। কিন্তু চা-শ্রমিকদের জীবনমানের আর উন্নতি হয়নি।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের চা-শ্রমিকদের থাকার জায়গাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ শ্রমিকের বসবাস মাটির তৈরি ঘরে। ঘরের উপরে কোনো কোনোটিতে শুকনো খড়ের আস্তরণ, আর কোনো কোনোটি টিন দেওয়া। অনেক ঘরেই খড় আর টিনের ফুটো দিয়ে আকাশ দেখা যায়। কোনো ঘরে একটাই কক্ষ, কোনোটিতে দুটি। বেশি হলে একটি আলাদা রান্না ঘর। কক্ষের আয়তনও খুব বেশি নয়। এসব কক্ষে তিন থেকে সাতজন গাদাগাদি করে থাকেন। অনেক কক্ষে আবার গৃহস্থের সঙ্গে গরু-ছাগলেরও বসবাস রয়েছে।
চা শ্রমিক শীত কুমার রিকিয়াসন ও যমুনা রিকিয়াসন। তাদের তিন সন্তান, তিনজনই মেয়ে। শীত কুমার রিকিয়াসন কাজ করেন শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও চা-বাগানে। তার ঘর লম্বায় ১৫ ফুট আর চওড়ায় ৬ ফুট। এতটুকু একটি ঘরের এক পাশে মাটির ওপর পাটি বিছিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন সবাই। আর অন্য পাশে থাকে তাদের পালিত গরু। গরু রাখার জন্য বরাদ্দ লম্বায় ৪ ফুট আর চওড়ায় তিন ফুট জায়গা। তার পাশেই পানির জগ আর রান্নার দুই-তিনটি হাঁড়ি-পাতিল। ঘরে উল্লেখ করার মতো আসবাবপত্র বলতে আছে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার।
আরও পড়ুন: পাহাড়িকা এক্সপ্রেস আটকে দিলেন চা-শ্রমিকরা
যমুনা রিকিয়াসন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বামী চা বাগানে কাজ করে দৈনিক ১২০ টাকা পায়। সেখান থেকে কেটে-ছেঁটে দৈনিক ১০০ টাকাও থাকে না। এই টাকা দিয়ে সব বেলায় খাবার জোটে না। ঘরে গরু না রেখে কী করব?
গরু পালনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার তলব ডাকা হয় (সাতগাঁও চা-বাগানের শ্রমিকদের প্রতি সপ্তাহের মজুরি দেওয়া হয় বৃহস্পতিবারে, যেটি স্থানীয়দের কাছে তলব হিসেবে পরিচিত), সেখানে যে টাকা পাই, তা দিয়ে ঠিকমতো চাল কিনে খেতে পারি না। কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে পারি না। ঘরের টিন নষ্ট হলে নতুন টিন লাগাতে পারি না। মজুরির টাকা দিয়ে চলতে না পারলে কিস্তি নিই। গরুর দুধ বিক্রি করে কিস্তি শোধ করার চেষ্টা করি। তাতেও কিস্তি শোধ করতে না পারলে গরু বিক্রি করে দিই।
একই জায়গায় কথা হয় আরেক চা-শ্রমিক নমিতা বাউরীর সঙ্গে। তার স্বামী সুধাংশু বাউরী বেকার। সংসার চালান নমিতা। তাদের ঘরেরও একই অবস্থা। ঘরের ডান পাশে একটি খাট। মাঝে একটি ছোট্ট টেবিল আর একটা পুরোনো শোকেস। জায়গা না থাকায় সেগুলো জিনিসপত্রে ঠাঁসা।
নমিতা বাউরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গবাদি পশুকে তো বাইরে রাখতে পারি না। তাই বাধ্য হয়ে ঘরে আমাদের সঙ্গেই রাখি।
তিনি বলেন, এত কষ্টে থাকি, তবু মজুরি তো বৃদ্ধি করে না। আমরা অনেক কষ্টে আছি। মালিকরা শুধু বলে, তারা আমাদের অনেক কিছু দিচ্ছে। কিন্তু আমরা তো পাচ্ছি না, সেগুলো যাচ্ছে কোথায়? শ্রমিকরা আন্দোলন এমনি এমনি করছে না, আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমাদের দাবি, দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করা হোক।
এএজে/এসএসএইচ