আছে ট্রলি ভয়, বসলেই ১০০-৫০০ গুনতে হয়
সকাল সোয়া ৯টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকতেই ধাক্কা দিলেন হকার। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, সরি। কিছু না বলে এগোতেই দেখা মিলল, হাসপাতালের ভেতরেই হকারের মাস্ক বিক্রির দৃশ্য। পিস ১০ টাকা।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখি, দাঁড়িয়ে আছেন নিরাপত্তাকর্মী। সার্জারি বিভাগের কথা জানতে চাইলে বললেন, ‘সোজা হাঁটেন, দেখতে পাবেন’।
নিরাপত্তাকর্মীর কর্কশ কথা কানে লাগলেও তার দেখানো পথে হাঁটছিলাম। ৯টা ২২ মিনিটে নিচ তলায় দেখা মিলল, অর্থপেডিক ও নিউরোলজি বিভাগের সার্জারি ওয়ার্ড; নম্বর ১১৪ ও ১১৫। নিচ তলার এই দুটি ওয়ার্ডে চিকিৎসকরা রোগীদের চেক-আপ করছেন। সঙ্গে সাদা কাপড়ের অ্যাপ্রন পরা নার্স এবং শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা রয়েছেন। দেখা যায়, দুই ওয়ার্ডের সামনের বারান্দায় কোনো রোগী নেই। বরং ভেতরে বেশ কিছু সিট খালি পড়ে আছে।
এর ঠিক উপর তলায় হলো- সার্জারির মূল বিভাগ। দোতলার পশ্চিম পাশ অর্থাৎ ২১৯-২২০ এবং পূর্বপাশের ২১৭-২১৮ নং ওয়ার্ডের সিটগুলো রোগীতে ভরপুর। ওয়ার্ডে জায়গা না পেয়ে বারান্দায় শুয়ে আছেন অনেক রোগী। একই অবস্থা শিশু সার্জারি বিভাগের ২১৩-২১৪ নং ওয়ার্ড দুটিতেও।
সেখানে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতেই দেখা যায়, এক নারী হুইল চেয়ার নিয়ে ২১৭ নং ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছেন। দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই তিনি হুইল চেয়ারে করে এক জন রোগীকে এমআরআই করতে নিয়ে গেলেন। রোগীকে হুইল চেয়ার থেকে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে টাকা চাইলেন ৫০০। রোগীর ছেলে দিলেন ১০০। তিনি নিলেন না, অনেক জোরাজোরি করার পর ৩০০ টাকা গুঁজে নিলেন।
একই নারী হুইল চেয়ার নিয়ে ফের সার্জারি বিভাগের সামনে অপেক্ষা করছেন! পরিচয় গোপন করে নাম জানতে চাইতেই ক্ষেপে উঠলেন। বললেন, ‘নাম দিয়ে কাজ কী? ট্রলি (হুইল চেয়ার) লাগে কি-না কন? কথা বলার সময় নেই’।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মচারী বলেন, ‘উনিসহ ৫-৬ জন নারী ট্রলি ব্যবসা করেন। এরা স্থানীয়, এদের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করা যায় না! যে রোগীর কাছ থেকে যত পারেন তাই নেন। কেউ কিছু বললেই গালি দিতে শুরু করেন।’
কুষ্টিয়া থেকে সার্জারি করতে আসা এনামুল বলেন, ‘আমি গত সপ্তাহ ভর্তি হয়েছি। প্রথমদিকে কিছু চিনতাম না। এই মহিলা আমাকে দোতলা থেকে নিচ তলায় নামিয়েই ৩০০ টাকা নিয়েছেন। কিছু করার নেই। এদের টার্গেট নতুন রোগী, নতুনদের দেখলেই হকারদের মতোই দৌড়ে আসেন।’
সাড়ে ১০টার দিকে এই চক্রের আরেক সদস্য ২১৯ নং ওয়ার্ড থেকে এক রোগীকে নতুন ভবনে নিয়ে যান। আবার ৪০-৪৫ মিনিট পর সেখান থেকে ওয়ার্ডে নিয়ে আসেন। তার কাছ থেকে নেন ৫০০ টাকা। হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় এবং নিরাপত্তাকর্মীরা এদের বলেন, ‘ট্রলি বাহিনী’।
নিয়ম না থাকা সত্ত্বেও কখনও হুইল চেয়ার আবার কখনও ট্রলি নিয়ে রোগীদের কাছে দৌড়ে আসেন তারা। কোনোভাবে ট্রলিতে বসাতে পারলেই ১০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন।
বিষয়টি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক স্বীকার করেছেন। তিনি ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘এখানে মহিলাদের একটি চক্র আছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা যখন রাউন্ডে (সরেজমিনে দেখতে) যাই তখন এরা খবর পেয়ে চলে যায়। আবার ঘুরে ফিরে আসে।’
তিনি বলেন, ‘এই চক্রটির নামে কেউ অভিযোগ না করায়, আমরা অনেক সময় ব্যবস্থা নিতে পারি না। কয়েক দিন আগে এক জনকে ধরেছিলাম। তখন মহিলা বলেন, এটা আমার রোগী। রোগীকে জিজ্ঞাসা করলাম তিনি কোনো উত্তর দেননি।’
হাসপাতাল পরিচালক আরও বলেন, ‘এদের হাসপাতাল ছাড়া করতে সরকারের কাছে ৮৮ জন লোক নিয়োগের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। প্রস্তাবটি অর্থমন্ত্রণালয় বাতিল করে দিয়েছে।’
এদিকে, রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে এমআরআইসহ বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে দেরি হচ্ছে। এর সঙ্গে ট্রলি বাহিনীর খপ্পরে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন হাসপাতালে আসা রোগীরা।
রোগীরা বলছেন, হাসপাতালের চিকিৎসকরা খুবই আন্তরিক। কিন্তু সরঞ্জাম না থাকায় সঠিক সময়ে পরীক্ষার জন্য দিতে পারছেন না। পরীক্ষা করিয়েও রিপোর্ট পাচ্ছেন দেরিতে। তার চেয়ে রোগীরা বেশি যন্ত্রণায় আছেন ট্রলি বাহিনীর জ্বালায়।
এমআই/এফআর