নিরাপত্তার বালাই নেই বিআরটি প্রকল্পে
উত্তরায় গার্ডার চাপায় একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হওয়ার পর থেকে বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (বিআরটি) প্রকল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে।
এদিকে দুর্ঘটনার পর থেকে অভিযোগের আঙ্গুল ওঠেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চীনের জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ও গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা যদি নিরাপত্তার বিষয়ে কঠোর হতেন তাহলে শিশুসহ পাঁচজনের প্রাণ এভাবে অকালে ঝরে যেত না।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উত্তরার রাস্তায় বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রকল্পের জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী ব্যবহার করেনি। খুব ঝুঁকিপূর্ণ দুই এক জায়গায় শুধু একটি লাল কাপড় দেওয়া হয় মাঝেমধ্যে।
দুর্ঘটনার পর উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসীনও জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার সময় সেখানে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল না।
আরও পড়ুন : রিয়া মনির সংসারের সুখ দেখা হলো না মায়ের
এছাড়াও স্থানীয়রা জানান, চীনা প্রতিষ্ঠান দুইটি দীর্ঘদিন ধরে অল্প সংখ্যক লোক দিয়ে কাজ পরিচালনা করছিল। যন্ত্রপাতিও প্রয়োজনের তুলনায় ছিল কম।
এ বিষয়ে ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (বিআরটি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা এর আগেও জেনেছি, তারা লোকবল কম রেখে, ইকুইপমেন্ট কম ব্যবহার করে কাজটা রানিং রেখেছে। কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রেও একই কথা। শুধু আমরা না সিটি করপোরেশন, মিনিস্ট্রি, এডিবি যার যতটুকু ক্ষমতা আছে সবাই কমপ্লায়েন্সের বিষয়ে প্রেশার দিয়ে যাচ্ছে। দুঃখের বিষয় মেয়র (মেয়র আতিকুল ইসলাম) বলেছেন, আমাদের কাজে খামখেয়ালিপনা হচ্ছে। সেটা আমরা ঠিকাদারদের কাছ থেকে পেয়েছি। কোনোভাবেই তাদের কাছ থেকে কমপ্লায়েন্স পাচ্ছি না। কম্পায়েন্স বা সিকিউরিটি একেবারেই নেই তা কিন্তু না, আছে। তা হয়ত ইন্টারন্যাশনাল যেভাবে করার কথা সেটা হচ্ছে না। শুধু এটা না, আরও কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে আজ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, বিআরটি কর্তৃপক্ষ আমার সামনে আছেন। আমি গতকালও তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। সচিবের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আমি বলেছি, বিআরটির কাজ বন্ধ করে দেব। আপনারা আমার সঙ্গে দ্রুতই বসবেন। শুধু এই প্রজেক্টই নয়, ঢাকা শহরে যতগুলো প্রজেক্ট চলছে, সবগুলো বন্ধ থাকবে। এ প্রকল্প কাজ পরিচালনায় ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। ফলে কিছুদিন পরপরই দুর্ঘটনা ঘটছে। জন দুর্ভোগ বাড়ছে। এভাবে উন্নয়ন কাজ চলতে দেওয়া যাবে না। আগে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন : উত্তরার ঘটনার পেছনে চার কারণ
এদিকে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দেখে সড়ক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেছেন, উত্তরার ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির বিষয়টি উঠে এসেছে। গতকালের (সোমবার) ঘটনার মূল দায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। তারা কাউকে না জানিয়ে কাজ করছিল, অথচ গতকাল কাজ বন্ধ থাকার কথা। এ বিষয়ে আর কারও কোনো দায় আছে কি না, তা খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মঙ্গলবার একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের গার্ডার দুর্ঘটনার বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে কয়েকটি কোম্পানিকে ব্ল্যাক লিস্টের নির্দেশনা দিয়েছেন।
রাজধানীর উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার দুর্ঘটনা যদি নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকার কারণে ঘটে, তবে তা স্পষ্ট অবহেলা- এমনটি মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ক্রেন থেকে গার্ডার কিন্তু দুর্ঘটনাক্রমে পড়ে যেতেই পারে, সে কারণেই পূর্ব সতর্কতা নিতে হয়। ইন্টারন্যাশনাল প্র্যাকটিস হচ্ছে, আমাকে কাজের জায়গায় আগেই নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে হবে। বেষ্টনীর মধ্যে যেন পথচারী বা কোনো যানবাহন ঢুকতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্বও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটির মুখপাত্রদের ফোন করা হলেও তারা সাড়া দেননি। ঘটনাস্থলের আশপাশেও পাওয়া যায়নি তাদের কোন প্রতিনিধিকে। আজ তাদের প্রকল্পের কাজও বন্ধ। তাই কথা বলার মতো একজন শ্রমিক-কর্মচারীকেও পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, সোমবার বিকেল ৪টায় রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের ফ্লাইওভারের গার্ডার চাপায় প্রাইভেটকারে থাকা শিশুসহ ৫ জন নিহত হন। আহত হন আরও দুইজন।
২০১২ সালে বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। শেষ করার কথা ২০১৭ সালে। তবে নানা জটিলতায় বারবার পিছিয়েছে কাজ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৬৮ শতাংশ। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। যদিও এ সময়ের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এমএইচএন/এসকেডি