ক্ষমতা আছে বলেই খুনি রাশেদ-নূরকে ফেরত দিচ্ছে না তারা : মোমেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশে ফেরত আনতে দীর্ঘদিন ধরে দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এখন পর্যন্ত রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরী ছাড়া বাকিদের অবস্থান নিশ্চিত করা যায়নি। রাশেদ ও নূর চৌধুরীকে দেশে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বিভিন্ন সময় অনেক চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ইচ্ছে করে খুনিদের বিচার করতে দিচ্ছে না তারা।
বছর দুয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীর আশ্রয় মঞ্জুরের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ। এতে খুনি রাশেদকে ফেরানো নিয়ে আশার আলো দেখা দেয়। তবে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
অন্যদিকে কানাডায় অবস্থান করা আরেক আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীর বিষয়ে কোনো ইতিবাচক সাড়া মিলছে না। বাকি তিনজন শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন খান ও খন্দকার আব্দুর রশিদ কোথায় আছেন সে বিষয়ে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রাশেদকে ফেরানোর বিষয়ে সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বাইডেন প্রশাসনের পাশাপাশি মার্কিন বিচার বিভাগ তথা অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে ঢাকার পক্ষ থেকে। তবে মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরানোর অগ্রগতি জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১০ সাল থেকে এটা নিয়ে আমরা কথা বলছি। দুজনের কথা আমরা জানি। বাকিদের কথা আমরা জানি না। আমাদের পুলিশও কিছু জানে না। এটা খুব দুঃখজনক। আমরা ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়েছি। টাকা ডিক্লেয়ার করেছি। কেউ যদি সঠিক তথ্য দিতে পারে তাহলে তাকে আমরা পুরস্কৃত করব বলেছি। তারপরও তিনজনের খবর আমরা জানি না। যে দুজনের খবর আমরা পেয়েছি তারা উন্নত দেশে থাকে। সেখানে তারা দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রাশেদ চৌধুরী প্রসঙ্গে ড. মোমেন বলেন, বাইডেন সরকারের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেস্টের সঙ্গে আমি নিজে আলাপ করেছি। তারা খালি বাহানা দেয়। তাকে ফেরতের কথা বললে বলে, এটা অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস দেখে। অ্যাটর্নি জেনারেলের সাক্ষাৎ চাইলাম আমরা। তিনি বললেন, যেহেতু কেস আছে তাই আমরা ইন্টারেস্টেড পার্টির সঙ্গে সাক্ষাৎ করব না। যত ধরনের ‘ওয়াল’ তৈরি করা যায় তারা সেটা করছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আরেকজন (নূর চৌধুরী) কানাডায় আছে, তারাও তাকে ফেরত দেয় না। বাকি তিনজনের খবর আমরা জানি না। তবে তাদের বিষয়ে জানার জন্য আমরা যত ধরনের প্রচেষ্টা আছে চালিয়ে যাচ্ছি। ইন্টারপোলকে বলা হয়েছে। আমাদের প্রবাসীরা চাপ তৈরিতে করতে পারেন এসব খুনিদের ফেরত আনার বিষয়ে।
রাশেদ-নূরকে ফেরত না দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সমালোচনা করেন মোমেন। তিনি বলেন, উন্নত দেশ যারা আইনের শাসনের কথা বলে, যারা বলে তাদের দেশে তারা খুনিদের আশ্রয় দেয় না, তারাই আমাদের এ খুনিদের আশ্রয় দিয়ে রাখছে। তাদের খুব সুখে-শান্তিতে রাখছে। এটা খুবই অন্যায়। তোমরা আইনের শাসনের কথা বল, অথচ খুনিদের জায়গা দিয়ে রাখছ, এটা ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। তোমাদের ক্ষমতা আছে বলে তাদের বিচারের সম্মুখীন করতে দিচ্ছ না, এটা-তো খুবই অন্যায়।
রাশেদ চৌধুরী
খুনি রাশেদ চৌধুরী ব্রাজিল থেকে ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ২০০৪ সালে দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পান তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করে। কিন্তু ফাঁসির আসামি বলে তাকে ফেরত দিতে অনীহা দেখায় যুক্তরাষ্ট্র।
খুনি রাশেদ চৌধুরী ব্রাজিল থেকে ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ২০০৪ সালে দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পান তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করে। কিন্তু ফাঁসির আসামি বলে তাকে ফেরত দিতে অনীহা দেখায় যুক্তরাষ্ট্র।
রাশেদকে ফেরত দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালে দুই বার এবং ২০২০ সালে আরও একবার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সঙ্গে একাধিক বৈঠকে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর দাবি তুলেছিলেন। ২০১৯ সালে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অ্যালিস ওয়েলসের সঙ্গে এক বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে রাশেদ চৌধুরীর বিচারের নথিপত্র চেয়েছে ওয়াশিংটন।
ঢাকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে গত বছরের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়টি পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয় দেশটির বিচার বিভাগ। এর মধ্যেই দেশটির ক্ষমতার পালাবদল হয়ে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হন। বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরও দেশটি থেকে রাশেদকে ফেরানোর বিষয়টি ওয়াশিংটনের প্রতিনিধিদের কাছে তুলে ধরে ঢাকা।
সবশেষ, চলতির বছরের এপ্রিলের শুরুতে ঢাকা-ওয়াশিংটন কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. মোমেন। সেখানেও রাশেদকে ফেরানোর বিষয়টি তোলা হয়। তখন মোমেন ব্লিঙ্কেনকে বলেছিলেন, খুনি রাশেদকে ফেরত দিলে ঢাকা-ওয়াশিংটনের ৫০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্ক একটি গেম চেঞ্জার হবে।
নূর চৌধুরী
খুনি নূর চৌধুরী বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নূরকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে একবার এবং ২০০৭ সালে আরেকবার নূরকে দেশে ফেরত পাঠাতে চায় কানাডা। কিন্তু তখন ক্ষমতায় থাকা বিএনপি-জামায়াত সরকার বিষয়টি নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে নূরকে ফের ফেরত চায় কানাডার কাছে।
এরই মধ্যে কানাডা থেকে বহিষ্কার এড়াতে নূর চৌধুরী সে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে প্রি-রিমুভ্যাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট (প্রাক-অপসারণ ঝুঁকি মূল্যায়ন) আবেদন করেন। সেখানে নূর উল্লেখ করেন, ‘কানাডা থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হলে তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে।’ এ ধরনের আবেদন সাধারণত এক বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করা হয়। কিন্তু নূর চৌধুরীর ক্ষেত্রে কানাডার অ্যাটর্নি জেনারেল ১১ বছরেও সেটি নিষ্পত্তি করেননি।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালের জুলাইয়ে কানাডার ফেডারেল কোর্টে একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় নূর চৌধুরীর অবস্থান সংক্রান্ত তথ্যের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার আবেদন করা হয়। পরের বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কোর্ট বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেয়। অর্থাৎ নূর চৌধুরীর অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য জানানোর জন্য কানাডা সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এ বিষয়ে কানাডার সরকার এখনও কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি
বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালের জুলাইয়ে কানাডার ফেডারেল কোর্টে একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় নূর চৌধুরীর অবস্থান সংক্রান্ত তথ্যের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার আবেদন করা হয়। পরের বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কোর্ট বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেয়। অর্থাৎ নূর চৌধুরীর অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য জানানোর জন্য কানাডা সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এ বিষয়ে কানাডার সরকার এখনও কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকায় আসা কানাডার নতুন হাইকমিশনার লিলি নিকোলস চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ড. মোমেনের সাক্ষাতে এলে তিনি হাইকমিশনারকে খুনি নূরকে ফেরত আনার বিষয়ে তার সরকারের সহযোগিতা চান। জবাবে হাইকমিশনার জানিয়েছিলেন, বিষয়টি তিনি কানাডা সরকারকে অবহিত করবেন।
মোসলেম উদ্দিন খান
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মধ্যে মোসলেম উদ্দিন খান ইউরোপের কোনো একটি দেশে পালিয়ে আছেন বলে ধারণা করা হয়। তবে করোনা মহামারির মধ্যে গত বছরের জুন মাসে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা বঙ্গবন্ধুর এ খুনি ভারতে আটক হওয়ার খবর ছাপে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারেনি।
শরিফুল হক ডালিম
বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি শরিফুল হক ডালিম পাকিস্তান, লিবিয়া বা স্পেনে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে সরকারের কাছে তার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই।
খন্দকার আব্দুর রশিদ
খন্দকার আব্দুর রশিদ পাকিস্তান বা আফ্রিকার কোনো একটি দেশে পালিয়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সরকারের কাছে তার বিষয়েও সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের ১৮ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সে সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পরবর্তীতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচারের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
২০২০ সালের ১১ এপ্রিল খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। তাকে ভারত থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২৪ বছর তিনি ভারতের কলকাতায় লুকিয়ে ছিলেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১২ খুনির একজন আজিজ পাশা ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান।
ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে প্রথমবারের মতো ওই ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৯৮ সালে এ মামলার বিচারে হত্যার দায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০০ সালে হাইকোর্ট ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০০৯ সালে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখলে আসামিরা রিভিউ আপিল করেন।
২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রিভিউ আপিল খারিজ করা হয় এবং পরদিন ২৮ জানুয়ারি পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তারা হলেন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন (আর্টিলারি)।
এর ১০ বছর পর ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। তাকে ভারত থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২৪ বছর তিনি ভারতের কলকাতায় লুকিয়ে ছিলেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১২ খুনির একজন আজিজ পাশা ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান।
এনআই/এসকেডি