রোদ-গরমে দিনভর পুড়ছেন শ্রমজীবী মানুষ
ষাটোর্ধ্ব আব্দুল হাইয়ের সংসারের চাকা ঘোরে রিকশার প্যাডেলে। তাই অন্য দিনের মতো আজও রিকশা নিয়ে বেরিয়েছেন সকাল ১০টায়। কিন্তু তীব্র গরমে সড়কে আর টিকতে পারছেন না। দেড়ঘণ্টা চালানোর পর রিকশা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন গ্যারেজে।
রাজধানীর মিরপুরের উত্তর পীরেরবাগে ৬০ ফিট সড়কে কথা হয় আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘৭১ সালে ঢাকায় আইছি। মাঝে ভোলায় গ্রামের বাড়ি আছিলাম কিছুদিন। নদীতে সব হারায়া ফের আইছি ঢাকায়। রিকশায় প্যাডেল মারি প্রায় ৪০-৫০ বছর। দুই ছেলে তিন মেয়েরে বিয়া দিছি। এখন যে যার মতো। নিজের সংসার তাই এই বয়সেও চালাই। লেখাপড়া জানি না। করতে পারি নাই। ভাগ্য খারাপ, ছোট বেলায় বাপ মইরা যাওয়ার পর এ রিকশাই এখন জীবিকার বাহন।’
আব্দুল হাই বলেন, ‘প্রচণ্ড গরম। আর পারতাছি না। গরমে আজ রিকশা আর চালাইতে পারতাছি না। যখন একটু ছায়া থাকে তখন চালাই। রিকশা নিয়া গ্যারেজে ফিরা যাইতেছি।’
আরও পড়ুন : এসএসসি শুরু ১৫ সেপ্টেম্বর, এইচএসসি নভেম্বরে
তপ্ত গরমে অতিষ্ঠ আব্দুল হাইয়ের মতো নিম্ন আয়ের বেশিরভাগ শ্রমজীবী মানুষ। বিশেষ করে রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ফেরিওয়ালাদের ভোগান্তি বেড়েছে বেশি।
মিরপুরের পাকা মসজিদ এলাকায় কথা হয় এমাদুল হক নামে আরেক রিকশাচালকের সঙ্গে। তিনি বলেন, গাজীপুরে চাকরি করতাম গার্মেন্টসে। সেখানে করোনার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। চাকরিটাও চলে যায়। এরপর বরিশালে গ্রামের বাড়ি চলে যাই।
এমাদুল বলেন, ‘কাজ না করলে খামু কী, কিছু না কিছু তো করতে হবে। এক মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওর কথা চিন্তা করে গ্রাম থেকে সাত মাস আগে ঢাকায় আসি। বারেক মোল্লার মোড়ে গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে চালাচ্ছি। এবার ঈদের আগে থেকেই প্রচণ্ড গরম। গরমে খুব কষ্ট হয়। ঘেমে যাই, ক্ষুধা লাগে, পিপাসা লাগে। এক টানা অনেকক্ষণ প্যাডেল মারা যায় না, আধা ঘণ্টা পরপর বিশ্রাম নিই। সকাল থেকে ১৫০ টাকার খাবার খেয়ে ফেলেছি। গরমে পরিশ্রম করা কঠিন।’
একই সড়কে কথা হয় রিকশা চালক রিপনের সঙ্গে। তিনি বলেন, গরমে খারাপ অবস্থা। কয়েক দিন তো বাতাসও ছিল না। আজ একটু বাতাস আছে। সকাল সাড়ে ৭টায় বাসা থেকে বের হই। এত গরম! কাজও ছাড়তে পারি না। মন চায় এক দেড়শ টাকা খেয়ে ফেলি। মন চাইলেও খাইতে পারি না। খাইলেই তো শ্যাষ! দুইটা মেয়ে আছে। ওদের কথা চিন্তা করে অনেক কষ্ট সয়ে যায় শরীর। দিনে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকার খ্যাপ মারি। গ্যারেজে দিতে হয় ৯০ টাকা। নিজের পকেট খরচা যায় আরও ১০০ টাকা। সব মিলে হাজার খানেক থাকে।
আরও পড়ুন : শ্রীলঙ্কার পর আর্থিক সংকটের মুখে আরও ১২ দেশ
৬০ ফিট সড়কের আমতলা এলাকায় ফুটপাতে ফেরি করে চা বিক্রি করতে দেখা যায় সিদ্দিক মিয়াকে (৭০)। কুমিল্লা থেকে আসা এ বৃদ্ধ ঢাকায় ৭-৮ বছর ধরে ফেরি করে চা-বিস্কুট বিক্রি করেন। তিনি নিজে এখনো হাল ধরে আছেন সংসারের।
তিনি বলেন, ‘বেশি বেচাকেনা নাই। মাইনষে তো এহনো ঢাকায় ফেরে নাই। রিজিকের মালিক আল্লাহ। গরমে খুব কষ্ট হইতাছে। ছায়া নাই, সড়কে গাছ নাই। ফুটপাতে বইসা গরমে পুইড়াই চা বেচি। রোজগার না কইরা উপায় নাই।’
ভাঙ্গা মসজিদ এলাকার ডাব বিক্রেতা আবু কালাম বলেন, ২০০১ সাল থেকে ঢাকায় আছি। তিন বছর ধরে ডাবের ব্যবসা করি। ডাব বিক্রিতে সংসার চলে। গরম যত বেশি, আমার ব্যবসা তত ভালো। কিন্তু এবার গরমটা অনেক বেশি। গরমে নিজেরই অবস্থা খারাপ। আবার ব্যবসা ছেড়ে বাসায়ও যেতে পারছি না।
আবহাওয়া অফিস বলছে, দেশের ১১টি অঞ্চলের ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠলে তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। তাপপ্রবাহ যেটা আছে, তা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। কিন্তু মানুষের মধ্যে গরম লাগার অনুভূতি বেশি হচ্ছে মূলত বাতাসে আর্দ্রতা না থাকার কারণে। বর্ষায় কয়েক দিন বৃষ্টি বেশি হলে তাপমাত্রা কমে যেত। এখন কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হলেও সেভাবে সারা দেশে বৃষ্টি হচ্ছে না। সে কারণে তাপমাত্রা কমছে না। ২০ জুলাইয়ের আগে এ অবস্থা পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুব কম।
আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা জানান, মৌসুমি বায়ু আসে দক্ষিণ দিক থেকে। সেখানে সমুদ্র পৃষ্ঠের ওপরের অংশে তাপমাত্রা বেশি থাকে। ফলে ওই দিক থেকে বাতাস এলেও তা গরম থাকে। ফলে বাতাসও পাওয়া গেলেও গরম অনুভূত হয়।
জেইউ/এসকেডি