শিশুর বয়স কমানোর সিদ্ধান্ত হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন
আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে শিশুর সর্বোচ্চ বয়স ১৮ বছর থেকে কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেই প্রস্তাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে শিশুর অধিকার, উন্নয়নে কাজ করা চারটি সংস্থা।
চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ, জয়েনিং ফোর্সেস বাংলাদেশ, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম এবং গার্লস নট ব্রাইডসের পক্ষ থেকে এক যৌথ সংবাদ বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশের পক্ষে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক (কর্মসূচি) নীনা গোস্বামী, জয়েনিং ফোর্সেস বাংলাদেশের পক্ষে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (গার্লস রাইটস) কাশফিয়া ফিরোজ, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের পক্ষে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি এবং গার্লস নট ব্রাইডসের পক্ষে কেয়ার বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রওনক জাহান ওই যৌথ বিবৃতিতে বলেন, গত ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত সরকারের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক থেকে বিদ্যমান আইনে থাকা শিশুর বয়স কমানোর জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিককালে কিশোর গ্যাংয়ের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তাররোধে শিশুর সর্বোচ্চ বয়স ১৮ বছর থেকে কমিয়ে আনার এ প্রস্তাবটি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আমরা শিশুর উন্নয়ন ও অধিকার রক্ষায় কর্মরত বিভিন্ন নেটওয়ার্কের সদস্যরা এই ধরনের প্রস্তাব ও আলোচনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্মের কারণে হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কার্যক্রম বাড়ছে। যা নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বয়স কমিয়ে কেবল শাস্তি দেওয়ার পরিধি বাড়িয়ে কিশোর গ্যাংয়ের মতো জটিল সামাজিক সমস্যার সমাধান বাস্তবসম্মত নয় বরং এটি সমাজে বাল্যবিবাহ, শিশু শ্রমিক বৃদ্ধির মত আরও নানাবিধ সমস্যাকে প্রকট করে তুলবে।
আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ নানা দিক বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘ পর্যালোচনার মাধ্যমে জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ এবং শিশু আইন ২০১৩ এ শিশুর বয়স ১৮ বছর নির্ধারণ করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে শিশুর বয়স কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
সরকার শিশুদের শিক্ষা, উন্নয়ন ও অধিকার রক্ষায় নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিচ্ছে। শিশুর বয়স কমানো হলে এ পদক্ষেপগুলো ফলপ্রসূ হবে না বলে আমরা আশঙ্কা করছি। কিশোর গ্যাংয়ের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তাররোধে আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে, কেন আমাদের শিশু-কিশোররা এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কারা তাদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখার জন্য কারা কিশোর গ্যাংকে ব্যবহার করছে এবং তাদেরকে সংশোধনের জন্য বিদ্যমান উন্নয়ন ব্যবস্থা কিশোর অপরাধীদের ক্ষেত্রে কতটা উপযোগী।
বিবৃতিতে তারা বলেন, আমাদের আরও খতিয়ে দেখতে হবে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের বেড়ে উঠা ও পড়াশোনার বাইরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারছি কি না। তাদের বেড়ে উঠার মধ্যে সৃজনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করতে পারছে কি না। প্রয়োজনীয় মনোসামাজিক সেবার ব্যবস্থা আছে কি না বা আমরা সব শিশুর জন্য ন্যায় ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা, পর্যাপ্ত সুস্থ ও গঠনমূলক বিনোদন, খেলাধুলা, বিশ্রাম, সাংস্কৃতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন কার্যকলাপের ব্যবস্থা ও পরিবেশ (পরিবার, কমিউনিটি ও বিদ্যালয়ে) দিতে পারছি কি না তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে আমাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন আমাদের কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে।
তারা বলেন, এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে শুধুমাত্র শিশুর বয়স কমানো কিশোর গ্যাংয়ের মতো গুরুতর সমস্যার সমাধান হতে পারে না। বরং আমরা বিশ্বাস করি এ ধরনের সিদ্ধান্ত শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠার এতদিনের সংগ্রাম ও অর্জনকে নিঃসন্দেহে পিছিয়ে দেবে। শিশুর নিরাপদ ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। তাই শিশুর সর্বোচ্চ কল্যাণের দিকটি মাথায় রেখে আমরা সরকারের কাছে শিশুর বয়স না কমিয়ে শিশুকে কীভাবে সব স্তরে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও খেলাধুলার সুযোগ তৈরি করে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সে দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
জেইউ/আইএসএইচ