পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে ‘ত্রিমাত্রিক নিরাপত্তা বলয়’
• অপপ্রচার রোধে সর্বোচ্চ নজরদারি
• নিরাপত্তা জোরদার সারা দেশে
• প্রতিটি থানায় গেছে নির্দেশ
• র্যাবসহ সাড়ে পাঁচ হাজার পুলিশ থাকবে মাঠে
• আকাশ পথে টহল দেবে র্যাবের এয়ার উইং
আর মাত্র দুই দিনের অপেক্ষা। ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন (২৬ জুন) ভোর ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে সেতু। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে র্যাবসহ সাড়ে পাঁচ হাজার পুলিশ সদস্য। এজন্য সাজানো হয়েছে ত্রিমাত্রিক নিরাপত্তা বলয়।
এছাড়াও, সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ও অপপ্রচার রোধে গ্রহণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ নজরদারি ব্যবস্থা।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, একটি মহল নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কিছু ঘটিয়ে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করছে। সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় শুধু পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরেই নয়, নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে রাজধানীসহ সারা দেশেই।
ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দেশের প্রতিটি থানায় নিরাপত্তা জোরদারে নির্দেশ পাঠিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে। গুজব-অপপ্রচাররোধে বাড়ানো হয়েছে সাইবার মনিটরিং।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. কামরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কেউ যাতে গুজব ছড়াতে না পারে, সেজন্য সার্বক্ষণিক সাইবার মনিটরিং করা হচ্ছে। উদ্বোধনের দিন পদ্মার দুই পাড়ে র্যাবসহ পুলিশের সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি সদস্য ইউনিফর্মে মোতায়েন থাকবেন। এর বাইরে বিভিন্ন বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা সাদা পোশাকে তৎপর থাকবেন।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু ও এর আশপাশের মানুষসহ সার্বিক নিরাপত্তায় দুটি থানার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। থানাগুলোতে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নৌপথে শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকবে নৌ-পুলিশ। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশের চাহিদা মোতাবেক আরও যদি ফোর্স লাগে তা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশ। আমাদের র্যাবের সদস্যরাও নিয়োজিত থাকবেন। আকাশ পথে টহল দেবে র্যাবের এয়ার উইং। অর্থাৎ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রিমাত্রিক বলয় সাজানো হয়েছে।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে যেকোনো ধরনের নাশকতা, গুজব অপপ্রচারের চেষ্টা ঠেকাতে আমাদের সাইবার পুলিশ, সিটিটিসি, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের সদস্যরা সক্রিয় মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
গত ১২ জুন পদ্মা সেতু পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে।
আরেক অনুষ্ঠানে সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ড, সিলেটে ট্রেনে আগুনসহ কয়েকটি ঘটনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে কোনো ষড়যন্ত্র কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, এগুলো অন্তর্ঘাত হতে পারে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। গোয়েন্দাদের কাছে কিছু খবর আছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা আমাদের আগেও ছিল, এখনও আছে।
এ প্রসঙ্গে র্যাব মহাপরিচালক বলেছেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের হুমকি কিংবা নাশকতার তথ্য নেই।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে গতকাল (২২ জুন) সেতুর দুই প্রান্তে র্যাবের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, গোয়েন্দা তথ্য, সাইবার মনিটরিংসহ অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ করে পদ্মা সেতু উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের হামলা বা নাশকতার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না। গোয়েন্দা নজরদারি ও সাইবার জগতে মনিটরিং বাড়ানোর মাধ্যমে জঙ্গিদের যে কোনো ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিতে প্রস্তুত রয়েছে র্যাব।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্নের স্থাপনা পদ্মা সেতু। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের এ আকাঙ্ক্ষা পূরণে আজ পদ্মা সেতু দৃশ্যমান এবং উদ্বোধনের অপেক্ষায়। সেতুর ওপর দিয়ে সবার নির্বিঘ্ন চলাচলসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র্যাব ফোর্সেসসহ সব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সর্বদা সজাগ রয়েছে।
সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে র্যাব বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত র্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। যেকোনো ধরনের নাশকতা বা হামলা মোকাবিলায় সেতুর দুই প্রান্তেই র্যাব স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডো টিম সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবে।
র্যাবের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, সমাবেশস্থল, টোল প্লাজা, ফলক উন্মোচন ও হেলিপ্যাড এলাকার নিরাপত্তার লক্ষ্যে র্যাবের প্রয়োজনীয় সংখ্যক টহল মোতায়েন থাকবে। অনুষ্ঠান চলাকালীন সার্বিক নিরাপত্তার জন্য র্যাবের কন্ট্রোল রুম, স্ট্রাইকিং রিজার্ভ, আউটার পেরিমিটার, পেট্রোল, মোটরসাইকেল পেট্রোল, ফুট পেট্রোল, বোট পেট্রোলিং, অবজার্ভেশন পোস্ট, চেক পোস্ট এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসিটিভি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে।
সেতুর দুই প্রান্ত, সমাবেশস্থলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে র্যাবের বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড দ্বারা সুইপিং সম্পন্ন করা হবে। র্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত থাকবে।
যেকোনো ধরনের নাশকতা বা হামলা মোকাবিলায় সেতুর দুই প্রান্তেই র্যাব স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডো টিম সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবে। পাশাপাশি যেকোনো পরিস্থিতিতে র্যাব এয়ার উইংয়ের হেলিকপ্টার সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে।
এছাড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সেতুর দুই প্রান্তেই র্যাবের মেডিকেল টিম নিয়োজিত থাকবে। সেতুর দুই প্রান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাটালিয়নগুলো নিজ নিজ কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করবে।
র্যাব সদর দপ্তরের কন্ট্রোল রুম (কন্ট্রোল রুমের হটলাইন নাম্বার: ০১৭৭৭৭২০০২৯) ও অনুষ্ঠান স্থলে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমের (অনুষ্ঠান স্থালের কন্ট্রোল রুম নাম্বার: ০১৭৭৭৭২০০৪৯) মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ ও সমন্বয় করা হবে।
তিনি বলেন, পর্যাপ্ত সংখ্যক টহল মোতায়েন এবং সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করার মাধ্যমে নাশকতাসহ যেকোনো ধরনের অশুভ তৎপরতা কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে।
দুই প্রান্তে পদ্মা সেতুর প্রবেশ স্থান ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে র্যাবের চেকপোস্ট স্থাপনের মাধ্যমে আগত যানবাহন ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশি করা হবে।
ভার্চুয়াল জগতে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের গুজব, উসকানিমূলক তথ্য, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো প্রতিরোধেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে র্যাব সাইবার মনিটরিং টিম অনলাইনে সার্বক্ষণিক নজরদারি অব্যাহত রাখছে। র্যাব সদর দপ্তর সার্বিক কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে মনিটর করবে।
অন্যদিকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন যেন নির্বিঘ্নে হয় এ লক্ষ্যে পুলিশ কাজ করছে উল্লেখ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানসহ এ উপলক্ষে সারা দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এসব অনুষ্ঠান যেন নির্বিঘ্নে হয় সেই লক্ষ্যে পুলিশ কাজ করছে।
পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে উদ্বোধন হওয়া নতুন থানাগুলোর মাধ্যমে উভয় পাড়ের মানুষ সহজেই আইনি সুবিধা পাবেন মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, পদ্মা সেতু উত্তর ও দক্ষিণ থানার কাজই হচ্ছে পদ্মা সেতুর আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষা করা। এই থানাগুলোর মাধ্যমে সাধারণ জনগণ সহজে আইনি সেবা নিতে পারবেন। এতে আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রমে গতিশীলতা আসবে।
তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে অনেকভাবে ষড়যন্ত্র হয়েছে। পদ্মা সেতু যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন বলেই পদ্মা সেতু হয়েছে।
জেইউ/এমএইচএস/এনএফ