তিন বিদ্যুৎ প্রকল্পে ভূমি ক্রয়-ক্ষতিপূরণে ৩৯০ কোটি টাকার দুর্নীতি
কয়লাভিত্তিক তিন বিদ্যুৎ প্রকল্পে শুধু ভূমি ক্রয়, অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে মোট ৩৯০ কোটি ৪৯ লাখ টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্নীতির পরিমাণ ১৫ কোটি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার, বাঁশখালী এস এস বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২৫৫ কোটি ও মাতারবাড়ী এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্রে আত্মসাৎ হয়েছে ১১৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারক এবং মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে যথাযথ বিশ্লেষণ না করে প্রভাবশালীদের স্বার্থে কয়লা ও এলএনজি প্রকল্প অনুমোদনের অভিযোগ রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে (ভারত, চীন,পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া) নির্মিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশি টাকায় ৩.৪৬-৫.১৫ মধ্যে থাকলেও নির্বাচিত প্রকল্পে বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের সুযোগ রেখে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম ২২ থেকে ৪৯ শতাংশ বেশি দাম পড়বে।
বুধবার (১১ মে) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক আয়োজিত ‘বাংলাদেশে কয়লা ও এলএনজি বিদ্যুৎ প্রকল্প : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটির সিনিয়র রির্সাচ ফেলো মো. মাহফুজুল হক ও মো. নেওয়াজুল মওলা গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন।
গবেষণায় বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে জ্বালানি খাতের উন্নয়নে দাতানির্ভর নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। একদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসারে সরকারের উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেই অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পে অধিক দুর্নীতি এবং দ্রুত মুনাফা তুলে নেওয়ার সুযোগ থাকায় প্রয়োজন না থাকলেও কয়লা এবং এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রভাবশালী মহলকে অনৈতিক সুবিধা প্রদানে প্রকল্প অনুমোদন, বিবিধ চুক্তি সম্পাদন, ইপিসি ঠিকাদার নিয়োগ, বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ এবং বিদ্যুৎ ক্রয়ে প্রতিযোগিতা ভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার না করে বিশেষ বিধানের আওতায় চুক্তি ও কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়েছে। কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে এবং পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে পরিবেশ দূষণ ও সংকটাপন্ন এলাকাসমূহে ঝুঁকি বৃদ্ধি পেলেও পরিবেশ অধিদপ্তর বিদ্যমান আইন ও বিধি কার্যকরভাবে প্রয়োগে ব্যর্থ- বন, নদী, খাস জমিসহ প্রাকৃতিক সম্পদের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি সাধন হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং পুলিশের গুলিতে আন্দোলকারীদের মৃত্যু; মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেও বিচার না হওয়াসহ অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। যা খাত সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীদের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে আরও উৎসাহিত করছে বলে মনে করি।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, কয়লা ও এলএনজি ভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নে নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতা (ক্রিটিক্যাল, সুপার ক্রিটিক্যাল, আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি) না থাকায় আমদানি নির্ভর প্রযুক্তি দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীন ও জাপানের পুরাতন এবং ব্রাউন ফিল্ড বয়লারগুলোকে গ্রিন নামে চালিয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
টিআইবির গবেষণাপত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে বলা হয়েছে, জ্বালানি সরবরাহ চুক্তি না করেই প্রতি টন কয়লার প্রাথমিক দাম ১২০ ডলার হিসাব করে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করায় দুর্নীতির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। উৎপাদন শুরুর পর প্রকল্প ব্যয়সহ জ্বালানি মূল্য, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের ওপর নির্ভর করে দাম ইচ্ছামাফিক বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম ২-৩ গুণ বেশি পরার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রভাবশালী বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার- আইপিপি) সরাসরি জ্বালানি আমদানির সুযোগ প্রদানে অনৈতিক চাপ প্রয়োগ ও আইন পরিবর্তন করে রাষ্ট্রীয় জ্বালানি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের ক্ষমতা রহিতকরণ হয়েছে। এর ফলে জ্বালানির দাম ক্রয় মূল্যের চেয়ে অধিক দেখানোর সম্ভাবনা এবং অর্থপাচারের ঝুঁকি রয়েছে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াটের জন্য নির্মাণ ব্যয় সরকারি প্রাক্কলন অনুযায়ী ৭-৮ কোটি টাকা হলেও বরিশাল প্রকল্পে ১৩.৭৫ কোটি টাকা এবং বাঁশখালীতে ১৬.৫ কোটি টাকা পর্যন্ত অনুমোদন; অতিরিক্ত টাকা সংশ্লিষ্টদের কমিশন হিসেবে গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে (ভারত, চীন,পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া) নির্মিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩.৪৬-৫.১৫ টাকা পড়লেও নির্বাচিত প্রকল্পে বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের সুযোগ রেখে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম ২২ থেকে ৪৯ শতাংশ বেশি দাম পড়বে।
জমি ক্রয় ও অধিগ্রহণে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে সংস্থাটি গবেষণায় দেখা গেছে, পার্শ্ববর্তী দেশে নির্মিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ০.২৩ একর এবং এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ০.০৫৩ একর জমি প্রয়োজন। কিন্তু গবেষণার আওতাভুক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রে মোট ৯৪২ একর অতিরিক্ত জমি ক্রয় বা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। গবেষণার আওতাভুক্ত ৩টি বিদ্যুৎ প্রকল্পে শুধুমাত্র ভূমি ক্রয়, অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে মোট ৩৯০ কোটি ৪৯ লাখ টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
এর মধ্যে বরিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্নীতির পরিমাণ ১৫ কোটি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার, বাঁশখালী এস এস বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২৫৫ কোটি ও মাতারবাড়ী এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্রে আত্মসাৎ হয়েছে ১১৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আত্মসাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত শ্রেণি হিসাবে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তারা হলেন- বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এনজিওকর্মী, ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ ও মধ্যস্বত্বভোগী।
গবেষণা অনুসারে আত্মসাতের বর্ণনায় বলা হয়েছে, ইজারাকৃত জমি ব্যবহারকারীদের ক্ষতিপূরণ বাবদ বরিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থ আত্মসাৎ ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা। আর ক্ষতিপূরণের অর্থ থেকে কমিশন আদায় হয়েছে ৪৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। যা বাঁশখালী এস এস বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫৫ কোটি টাকা।
ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি জবরদখল এবং অর্থ প্রদান না করা ২ কোটি ৪১ লাখ আদায় হয়েছে বরিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে। একই বিদ্যুৎকেন্দ্রে খাস জমির জাল দলিল তৈরি করে তা বিক্রয় বাবদ অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে ১০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
অন্যদিকে বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যক্তিগত জমি ক্রয় ও অধিগ্রহণ বাবদ মূল্য প্রদানে কমিশন আদায় হয়েছে ২০০ কোটি টাকা।
আর মাতারবাড়ী এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৮২ কোটি ৫ লাখ টাকা ও একই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যক্তিগত জমির ক্ষতিপূরণের এককালীন অনুদানের টাকা আত্মসাৎ হয়েছে ৩৩ কোটি ও ব্যক্তিগত জমির ক্ষতিপূরণ থেকে এককালীন ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা কমিশন আদায় হয়েছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, সাময়িক সময়ের জন্য দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০১০ সালে ৪ বছর মেয়াদে বিশেষ বিধান আইনটি প্রণয়ন করা হলেও উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও ৩ দফা মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২৬ সাল পর্যন্ত আইনটি কার্যকর রাখা হয়েছে। এই আইনের আওতায় পরিবেশ বান্ধব এবং আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী নয় এমন বড় ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পসমূহ অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি জানিয়েছে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গবেষণাপত্র তৈরি করা হয়েছে।
আরএম/ওএফ